কোথা চাঁদ আমার লেখকঃ আঁধারের কাব্য

আমি তখন ক্লাস টেনে। সবে কৈশোরে পা দিয়েছি। সবকিছুই ভালো লাগে। যা দেখি সবকিছুতেই হাসি পায়। আমরা তিনজন খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। তিনজনই হাসতাম সারাক্ষন। আমার গানের টিচার থেকে ক্লাস টিচার সবাই বকা দিতো এ জন্য। তবু হাসতাম।


আমি তখন ক্লাস টেনে।
সবে কৈশোরে পা দিয়েছি। সবকিছুই ভালো লাগে। যা দেখি সবকিছুতেই হাসি পায়। আমরা তিনজন খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। তিনজনই হাসতাম সারাক্ষন। আমার গানের টিচার থেকে ক্লাস টিচার সবাই বকা দিতো এ জন্য। তবু হাসতাম।
একদিন ক্লাস করে টিফিন এ বাইরে গেলাম তিনজন। ফিরতে দেরী হলো। ক্লাসে ঢুকতেই দেখি একটা রাজপুত্রের মতো ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তখন সাহায্য নিতে অনেকে আসতো। আমি আবার খুব দান করতে ভালোবাসতাম।
কারো কষ্ট দেখতে পারতাম না।
আমি ভাবলাম, ‘আহারে! এত সুন্দর একটা ছেলে ! কতই বা বয়স !
২৩ !
না জানি কি সমস্যা।
যেই ভাবা অমনি ব্যাগ থেকে একটা একশত টাকার নোট উনাকে দিলাম ক্লাসে ঢুকতে ঢুকতেই।
উনি তো অবাক !
সবাই হাসতে লাগলো।
আমি বোকার মতো চশমা ঠিক করতে লাগলাম।
স্যার এবার বুঝিয়ে বললেন!

উনী অনীল দাদা।
বুয়েটে পড়েন!
আমাদের অনেক সিনিয়র।
বাসায় বেড়াতে এসেছেন।
তো সে জন্য আমাদেরকেও পরামর্শ দিতে এসেছেন।
আমি সিটে গিয়ে বসলাম।খুব লজ্জা লাগছিলো।
টাকাটাও নেয়া হলো না।
ক্লাস শেষে উনি আমাকে ডাকলেন।
বাইরে বারান্দায় গেলাম!
বললেন,’তুমি তন্যির ছোট ভাই না?আমাকে চিনতে পার নি?তোমাকে স্কুলের একটা প্রোগ্রামে এনেছিলো।আমি কোলে নিয়েছিলাম।’
-‘আমার মনে নেই।’
-‘তোমাদের বাসায় যাবো আজ।তন্যিরও তো ছুটি চলছে।না?’
-জ্বি।আসবেন।
সেদিন বিকেলে গান শিখছিলাম।
”সুরে ও বাণীর মালা দিয়ে তুমি আমারে ছুঁইয়াছিলে”।

সুরগুলো ঠিক হচ্ছিলো না।
বাইরের দরজায় কান দিয়ে আছি।গানে মন বসছে না।
এর মধ্যে কখন যে আবার ধ্যানমগ্ন হয়ে গেছি গানে বুঝতেই পারি নি।কাজের মেয়েটা এসে ডাকলো।
সেদিনের মতো গান শেখা শেষ।বসার ঘরে গিয়ে দেখি অনীল দা।আমার ভয় লাগলো।আপুকে বলে দেননি তো?আপু দেখছি খুব হাসছে!
এর উপর হঠাৎ উদয় হলেন শিশির ভাইয়া।
আপুর হবু বর।
আমার খুব পছন্দের।
আমাকে খুব স্নেহ করেন।
আপু পরিচয় করিয়ে দিলো অনীল ভাইয়ার সাথে।

এরপর,সবাই মিলে অনেক গল্প হলো।
সন্ধ্যার পরে নাশতা করে দুই ভাইয়া যেতে চাইলেন।
আমার মা জননী তাঁদের রাতের খাবার না খেয়ে যেতে দেবেন না!
অগত্যা!
হবু জামাই এর ব্যপার বুঝলাম!কিন্তু,অনীলদাকে যেতে দিলেই হতো!

তখন খু্ব গরম!
সবাই ছাদে গেলাম।বিদ্যুৎ নেই।
আপু আর শিশির ভাইয়াকে রেখে আমরা অন্যপাশে গেলাম।
অনীলদা বললেন,’তুমি এখনো ছোটবেলার মতো আছো।অনেক কিউট!’
-‘আপনিও অনেক হ্যান্ডসাম!আগে ভাবতাম,শিশির ভাইয়া সবচেয়ে সুন্দর!এখন দেখছি আপনি!’
-‘তাই?তো আমাকে দেখে ভিখিরী মনে হলো কেন?’
-‘স্যরি!’
-‘এর জন্য তোমাকে শাস্তি পেতে হবে!’
-‘কি শাস্তি?’
-‘কাল তো তোমারও ছুটি হবে।না?পরশু থেকে প্রতি বিকেলে আমার সাথে ঘুরবে!অনেক বছর পর আবার এখানে এসেছি।এ জন্য!’
আমার গানের টিচারও কোথায় যেন যাচ্ছেন!ভালোই হলো। এতো সুন্দর একটা মানুষের সাথে ঘুরবো ভাবতেই ভালো লাগছে!
আমার আসলে মেয়েদের ভালো লাগতো না।আগে থেকেই জানতাম!কিন্তু,সমকামীতা কি?এসব বুঝতাম না।জানতাম না।

পরশু চলে আসলো।
ভালো লাগাটা দ্বিগুন হলো যখন দেখলাম উনি বাইক নিয়ে এসেছেন!
আমাকে উঠতে বললেন!
আমি উঠলাম।একটু দুরত্ব রাখলাম।
কিছুদূর গিয়ে পড়তে শুরু করেছিলাম।
উনি বাইক থামালেন।
বললেন,’আমি কি খুব খারাপ?পছন্দ হচ্ছে না?’
-‘না না।তা কেন?’
-তা হলে ভালো করে ধরো!পড়ে গিয়ে কিছু হলে আন্টিকে কি বলবো!
আমি কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে উনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম!
তারপর!
কত জায়গায় ঘুরলাম!
সন্ধ্যা হলেই বাড়ি আসতাম!
আমার সব ফ্রেন্ড হারিয়ে গেলো।
শুধু অনীলদা আমার পুরো জগৎ দখল করে নিলো।
আপু মাঝে মাঝে মজা করতো এটা নিয়ে!’তুই অনীলের প্রেমে পড়িস নি তো?’
আমি লজ্জা পেতাম!
খুব বলতে ইচ্ছে হতো ‘হ্যা’।
কিন্তু,বলা যায় না।
আমরা কত কথা বলতাম!কত হাসি।কত গান শুনাতাম!
উনার ছুটি শেষ হয়ে এলো।
যাবার আগের দিন বিকেলে আমরা বসলাম একটা নির্জন জায়গায়।
অনেক কথা বলা হলো।
উনি বললেন যে আমাকে অনেক মিস করবেন!
শুধু মিস!
আমার জগৎ যে উনি শূন্য করে গেলেন তা বলতে পারলাম না!
উনি বললেন যে আমি নাকি অনেক বোকা।
শেষে বললেন,’তুমি কি ঐ গানটা জানো?’কোথা চাঁদ আমার?’জানো?’
-‘না।শিখে নেবো।এবার আসলে শুনাবো।’
-‘আর বোধহয় আসা হবে না।তোমার সাথে দেখাও হবে না!’

উনি চলে গেলেন।
আমার হাসিগুলো কেড়ে নিয়ে গেলেন!
কারো সাথে বেশি কথা বলতাম না!
কারো জন্য জীবন থেমে থাকে না!আমার জীবন ও চলতে থাকলো।
এইচ এস সির পর ঢাকা মেডিকেল কলেজে চান্স পেলাম।
ততদিনে সমকামীতার সাতকাহন জেনে ফেলেছি!
কিন্তু,অন্যকাউকে ভালোবাসি নি।
অনীলদাকেই ভাবতাম!
মন বলতো একদিন ঠিক আসবেন।
উনার ফোন নম্বরও নেই।যোগাযোগের কোনও উপায় নেই।
হঠাৎ,একটা সেমিনারে উনাকে দেখলাম।
প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ার।ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের একটা সেমিনার ছিলো।
উনিই আমাকে ডাকলেন!
কথা বললেন!
উনার ফ্ল্যাটে নিয়ে গেলেন।
একাই থাকেন!

অনেক গল্প হলো।
অনেক জমে থাকা কথা।
হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ!
উনি দরজা খুললেন।
একটা রাজকন্যার প্রবেশ।
পরিচয় করালেন।
-‘তোমার হবু বৌদি!’
দুনিয়াটা কি নিষ্ঠুর!

যাকে ভালোবাসার কারণে আর কোনও দিকে তাকাইনি সেই তিনি হবু বৌদির সাথে পরিচয় করালেন!
অবশ্য উনার কি দোষ?
উনি তো কখনো আমাকে কিছু বলেন নি!
আমার চোখে জল এলো।
উনি বললেন,’কি হয়েছে?’
-চোখে কি যেন পড়েছে!
-ও আচ্ছা।

অনেকক্ষন গল্প করে চলে আসলাম!
এবার অবশ্য ফোন নম্বর দেয়া নেয়া হলো।
আমি রুমে এসে অনেক কাঁদলাম!
কেন এভাবে আবার দেখা হলো!
হলো যদি তবে এটা কি জানলাম!
উনি কি আমাকে কখনো ভালোবাসেন নি?
আরেকদিন আমাকে যেতে বললেন।
গেলাম।
গিয়ে দেখি অনেক জ্বর!
আমি ঔষধ লিখে পাশের ফ্ল্যাটের ছেলেটাকে দিয়ে আনালাম।
অল্প কিছু রান্না করলাম!
উনি বসতেও পারছিলেন না!\
আমি তুলে খাওয়ালাম!
বললেন,’তোমাকে কষ্ট দিলাম!’
-এসব কষ্ট আমার ভালো লাগছে।
-তাহলে কিন্তু আরো কষ্ট পাবে!

দুজনেই হাসলাম।
উনি ঘুমুলেন।উনাকে একা রেখে আর যাই নি।
আমিও উনার পাশেই শুলাম!
বাইরে থেকে আসা আলোয় অন্য রকম মনে হচ্ছিলো সব!
উনার মায়াবী চেহারা!
এত কাছে তবু আমার না!
মাঝরাতে উনার কপালে হাত দিলাম!
জ্বর নেই!
আমাকে জড়িয়ে ধরে উপরে উঠলেন!
তারপর বললেন,”তুমি এতো বোকা কেন?আমি তোমাকে প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়েছিলাম!এতদিন বলতে সাহস পাইনি।সেদিন তোমার চোখে জল দেখে সব বুঝেছি!আমার আর দ্বিধা নেই!”
আমি তখন ১৯ উনি ২৬।
আমি উনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলাম অনেকক্ষন!
উনি বললেন,”আজ কাঁদছো কেন?আজ তো আনন্দের দিন!”
এরপর পরম পাওয়া পেলাম!

তারপর থেকে ভালোবাসাবাসি চলতে থাকলো।
ঐ মেয়েটা উনার বাবা মায়ের পছন্দের!
কিন্তু,আমার কপালে সুখ সহ্য হলো না!
উনার বিয়ে হলো সেই সৌভাগ্যবতীর সাথে।
আমার ফোন রিসিভ করতেন না!
আমিও ভাবলাম যে আমার প্রয়োজন তাঁর কাছে শেষ।
তবুও অন্য কাউকে মন দিইনি।
আরো কয়েকবছর পর সিঙ্গাপুরে একটা হাসপাতালে আমি সার্জন হিসেবে কাজ করছি।
বাংলাদেশ থেকে একজন অত্যন্ত ধনী ব্যাক্তি এসেছেন!
হার্ট সার্জারী হবে!
আমি গেলাম!
ফুটফুটে একটা বাচ্চার হাত ধরে বৌদি দাঁড়িয়ে আছেন!
যা বুঝার বুঝলাম!

জীবনের সবচেয়ে কঠিন অপারেশন হয়তো আমার জন্য।
অপারেশন করলাম!
উনার জ্ঞান ফেরার পর সুস্থ হলে গেলাম কথা বলতে!
-‘তুমি?’
-হ্যা।আমি।তোমার মনটাতে একটু ধুলি জমেছিলো তো।পরিস্কার করে দিলাম।ওই মনের কোথাও না কোথাও হয়তো আমার জায়গা ছিলো!

আমি চলে আসলাম।উনাকেও আজ রিলিজ দেয়া হবে!
বলতে পারলাম না,”অনীলদা একটা গান শুনবে?বড় যত্ন করে শিখেছি।তোমাকে শুনাবো বলে!”

“কোথা চাঁদ আমার,
ভুবন ভরিয়া মোর ঘিরিলো আঁধার..
..
…….
..
ফিরে এসো খোলা আজো দখিনা দুয়ার!”

জানি উনি ফিরে আসবেন না!
আমি হয়তো চাইও না তা!
এই তো বেশ আছি!
বিরহ নিয়ে!

—সমাপ্ত—-

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?