দহন - নিনিত


হাই, আমি নিঝুম। কথা শুনেই মুখ তুলে চাইল রবিন। উবু হয়ে জুতার ফিতা বাধছিল সে। সোজা হয়ে দাড়িয়ে হাসি নিয়েই হাত মেলাল নিঝুমের সাথে। নিঝুম পাঁচ ফিট সাতের মত হবে, গায়ের রঙ উজ্জ্বল হলুদাভ। স্বাভাবিকের চেয়েও উজ্জ্বল লালচে ঠোটজোড়া কাটকাট চেহারার সাথে বেশ মিলিয়ে গেছে। বেশ সুদর্শন কিন্তু কেন যেন আকর্ষণ করেনা। হাত মিলিয়েই নিঝুম জানতে চাইল, আপনি কি নতুন মেম্বার হয়েছেন? মুখে হাসি নিয়েই রবিন বলল, হ্যাঁ, এইতো সপ্তাখানেক । বলেই রবিন কার্ডিও করতে শুরু করেদিল। নিঝুম আরও কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু রবিনের অনাগ্রহটা বুঝতে পেরে আর কিছু বললনা।

রবিন লম্বা চওড়া এক পুরুষ। বিশাল পেশিবহুল কাঠামো নয়। তবে বেশ আকর্ষণীয়। শরীরের গাড়ো রঙ আর লোমশতা ওকে দিয়েছে অন্যরকম এক মাত্রা। মুখের গড়নটা এমন যে, মনেহয় কোন ভাস্কর পাথর খোদাই করে বানিয়েছে। রাশভারি কিন্তু মায়াবি হাসি যে কাউকে খুব কাছে টানে। অসম্ভব ব্যক্তিত্ববান মানুষ হিসেবেই সবাই ওকে জানে। ওর শরীরের ঘ্রাণটাও একটু আলাদা। একটা অদ্ভুত মাদকতায় ভরা। ঠিক অনেক মানুষের মধ্যে থেকে ওকে আলাদাভাবে চেনা যায়। শিক্ষাজিবনে অনেক মেয়েই আহ্বান জানিয়েছিল প্রনয়ের, কখনোবা অভিসারের। কিন্তু রবিন আলাদা ধাতে গড়া। এতো সহজে কারও কাছে ধরা দেয়নি সে। কি জানি কেন! সে কখনোই কারও প্রেমে পড়েনি। শরীরের আসক্তি তাকে কখনো গ্রাস করেনি। এটা এখনো একটি রহস্য।


জিমে একটু পর পরই নিঝুম রবিনকে দেখে। নিঝুমের চোখে থাকে ঘোর লাগা দৃষ্টি। ভাল লাগা আর আকঙ্খার মাত্রা যখন নিজের সীমাকে ছাড়িয়ে যায় তখন সত্যিই নিঝুমের চোখ লাল হয়ে আসে। রবিনের শরীরের প্রতিটি পেশির নড়াচড়া নিঝুমকে আন্দোলিত করে। নিঝুমের মনে তখন জপমালার আধিপত্য, আহা! কি সুন্দর! কি সুন্দর! রবিনকে ছুয়ে দেখার আকুতি নিঝুম কুঁড়ে কুঁড়ে যন্ত্রণা দেয়। মাঝে মাঝে রবিনের সাথে চোখে চোখ পরে যায়। চোখে চোখে হাসির বিনিময় হয়। এক টুকরো শান্তি নিঝুমকে আহ্লাদে আটখানা করে। কি থেকে কি করবে নিঝুম ভেবে পায়না। একেই বোধয় বলে সুখের মত ব্যথা। একই সাথে সুখ আর কষ্ট নিঝুমকে নিয়ে খেলা করে। আজকাল তার জিমে আসা বেকার হচ্ছে। কোন কিছুতেই ঠিক মনোযোগ দিতে পারেনা নিঝুম।
এ দৃষ্টির মানে বোঝে রবিন। কিন্তু সে এসব গায়ে মাখতে চায়না। এসব তার গায়ে মাখলে চলবেনা। যা হবেনা তা নিয়ে স্বপ্ন দেখতেও রাজি নয় সে। অনেক ছোটবেলাতেই সে স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিয়েছে। জিম থেকে বেড়িয়ে সে বাসার পথ ধরেছে। খুব অন্যমনস্ক হয়ে সে হাঁটছে। হাটার সময় সে তাকিয়ে আছে তার জুতোর দিকে। যেন, জুতোর মধ্যে সে নিজের সকল সীমাবদ্ধতা দেখতে পায়। মাঝে মাঝে অসংখ্য মানুষের ভিড়ের মধ্যে সে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে চায়। কিন্তু পারেনা। কারন সেখানেও কেউনা কেউ তাকে খুঁজে পায়। বাসায় পৌঁছে বিমর্ষ রবিন যখন ছল ছল চোখে তার মায়ের দিকে চায়, মা সব বুঝে নেয়। পানিতে ভরে যায় মায়ের চোখ। মা রবিনকে কাছে ডেকে কোলের উপর মাথাটা নিয়ে হাত বুলিয়ে দেয়। সে মনে মনে ঈশ্বর, ভগবান, আল্লাহ্‌ কাউকে স্মরণ করে। প্রচণ্ড ক্ষোভ আর কষ্ট নিয়ে সে বলতে থাকে, আমার বাছার কষ্টটা কমিয়ে দাও মাবুদ। একটু দয়া কর। একটু দয়া কর। মায়ের চোখের অশ্রু টপ টপ করে রবিনের গালে পরে। কিন্তু রবিনের চোখে ছল ছল পানি আর গড়িয়ে পরেনা। চোখের পানি চোখেই শুকিয়ে যায়।


আজ সাদিয়া খুব সুন্দর করে সেজেছে। যৌবনের একটা পর্বে মেয়েদের শরীর আর মনে একটা অন্যরকম স্নিগ্ধতা আসে। এখন সাদিয়ার সেই সময় চলছে। বেগুনি রঙের সুতি শাড়ি, খোপায় এক গুচ্ছ কামিনী ফুল, কপালে ছোট্ট একটি কালো টিপ আর চোখে হালকা করে এক পরত কাজল টানা। যেকোনো সমঝদার আদমপুত্র স্বর্গের হুর ছেড়ে দিতে রাজি হবে সাদিয়ার জন্য। খুব তড়িঘড়ি করেই বের হয় সাদিয়া। দুই নাম্বার বাসটা ধড়তে না পারলে আর ওর সাথে দেখা হবেনা। সমস্ত দিনটাই মাটি হয়ে যাবে। বাসটা প্রায় ছেড়েই যাচ্ছিল, অল্পের জন্য বাসটা মিস হয়নি। দ্রুত বাসে উঠেই অস্থির চোখে খুজতে লাগল সে। হ্যাঁ, পাওয়া গেছে। হাপ ছেড়ে এক কোনায় দাঁড়াল সে, যেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় মানুষটাকে। বাসে যতক্ষণ থাকে ততক্ষন মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। মুখে মৃদু হাসি। একটা সুখের অনুভূতি সাদিয়ার সমস্ত স্বত্বায় একটি পরশ বুলিয়ে যায়। এই এক চিলতে সুখ সাদিয়ার কাছে সারা দিনের জ্বালানি। মানুষটা আর কেউনা, রবিন।
রবিন বাসে বসে প্রায়ই খেয়াল করে, পরীর মত মেয়েটি ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রবিন কখনো বিব্রত হয়, কখনো কৌতুক বোধ করে, কখনোবা দুঃখে হেসে ফেলে। রবিন সিদ্ধান্ত নেয় সে মেয়েটির সাথে কথা বলবে। নির্দিষ্ট স্থানে এসে সে বাস থেকে নামে। নামার আগে সে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে চেয়েও ঠিক বলতে পারেনা। কিন্তু সে নেমে দাড়িয়ে থাকে। মেয়েটি কি বুঝল কে জানে! তবে সেও নেমে পড়ে। আজ অফিসে লেট হয় হোক। সাদিয়া মনে মনে প্রচণ্ড আনন্দিত। বাসটি ছেড়ে যায়। রবিন আর সাদিয়া পাশাপাশি দাড়িয়ে থাকে। দুজনে একটি কথাও বলেনি। সাদিয়া হালকা হাসি নিয়ে নিজের শাড়ির আচল দেখছিল। রবিন একটি রিক্সা ডাকে। রিক্সায় উঠে সে একপাশে চেপে বসে। সাদিয়া এক মুহুর্তও দেড়ি না করে উঠে পড়ে। সে আর কিছুই ভাবতে পারছেনা। সে শুধু ভাবছে সে তার কাঙ্খিত মানুষটির সাথে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে এসব প্রশ্ন তার মাথায় আসেনা। কোন এক অদ্ভুত কারনে সে মানুষটাকে ভরসা করে। এর মধ্যে তারা একটি কথাও বলেনি। একটি কথাওনা। রিক্সা একটি রেস্টুরেন্টের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে থামায় রবিন। দুজনেই নেমে পড়ে। দুইটা কফির অর্ডার করে রবিন। ওরা তখনো কোন কথা বলেনি। সাদিয়া একমনে তার হাতের ব্রেসলেট নাড়াচাড়া করে। তখনো তার মুখে রাজ্যের শান্তির হাসি। কিছুক্ষন পর তারা বেরোয়। রাস্তা ধরে তারা হাঁটতে থাকে। তাদের জন্য যেন সমস্ত পৃথিবী নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। সাদিয়া শুধু শোনে রবিনের জুতার আওয়াজ, তার শ্বাস নেয়ার আওয়াজ। প্রায় গাঁ ঘেসাঘেসি করে হাটার সময় সাদিয়া রবিনের গায়ের ঘ্রান পায়। রবিন কেবলই কামিনী ফুলের গন্ধ। তারা দুজনেই পাশাপাশি হাঁটছে, কেউ কারও সাথে একটি কথাও বলেনি, কেউ কারও দিকে তাকায়নি পর্যন্ত। একসময় দুজনেরই মনেহয় এবার যাওয়া দরকার। রবিন সাদিয়াকে ওদের বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। যাওয়ার সময় কেবল বলে “আসি” । সেই ভরাট কণ্ঠের “আসি” শব্দটি শত সহস্রবার করে সাদিয়ার কানে বাজে। পৃথিবীর সবটুকু সুখ যেন সাদিয়ার করতলে আসতে যাচ্ছে। প্রচণ্ড আনন্দে সাদিয়া ঘরে, ছাদে, বাগানে নেচে বেড়ায়। রাতে সে ঘুমোতেও পারেনা।


আজ খুব সকালেই সাদিয়া গোসল করে স্নিগ্ধ সাজে বেড়িয়ে পড়ে। দুই নাম্বার বাসটি এসে দাড়ায়। সাদিয়া বাসে উঠে চারপাশে তাকিয়ে মানুষটাকে দেখতে পায়না। সাদিয়া ভাবে মানুষটার আজ লেট হয়ে গেছে। সে বাস থেকে নেমে পড়ে। তিন নাম্বার, চার নাম্বার একে একে সব বাস চলে যায়। সাদিয়া বাড়ি ফিরে যায়। আবার পরেরদিন সে এসে দাড়ায় সেই বাস স্ট্যান্ডে। দুই, তিন, চার সব বাসই ছেড়ে যায় কেবল সাদিয়া যায়না। মানুষটাকে সে কোথাও খুঁজে পায়না। একদিন সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। সাদিয়া ঠায় দাড়িয়ে থাকে। তার চোখে কিন্তু পানি নেই। একটা উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। উস্কখুস্ক চুল, চেহারায় একটা কঠিন ভাব নিয়ে সে দাড়িয়ে থাকে। মানুষটা আর কোনদিন আসেনি। সাদিয়া প্রতিদিন সকালে একই নিয়মে দাড়িয়ে থাকে। সকাল থেকে সন্ধ্যা। সে আজও কারও সাথে কোন কথা বলেনা।


সেদিন রবিন বাড়ি ফিরে গিয়ে মাকে বলেছিল তাকে নিয়তির কাছে ছেড়ে দিতে। মা আর বাঁধা দেয়নি ছেড়ে দিয়েছিল।

ঐদিকে নিঝুম অনেক খুজেছিল রবিনকে। জিম থেকে নাম্বারও নিয়েছিল। কিন্তু নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া গেছে। হাল ছারেনি নিঝুম। সে প্রতিদিন ঐ নাম্বারে ফোন দেয়। যদি কখনো খোলা পাওয়া যায়। যদি কখনো অপাশে রিং বেজে উঠে। এমনই এক ভর দুপুরে ভিয়াইপি ২৭ এর বাসে বসে জ্যামে আটকা পরেছিল নিঝুম। হঠাৎই কিছু বিশাল আকারের মেয়ে মানুষ তালি বাজাতে বাজাতে যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে। ভালোভাবে তাকিয়ে নিঝুম বুঝল ওরা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। এর মধ্যে একজন ওর বেশ দৃষ্টি কাড়ল। সে একটু আলাদা ছিল। একটু আলাদা। ঠোঁটে লাল টকটকে লিপস্টিক, পড়নে সিল্কের শাড়ি, নাকে নথ দেয়া। সে তালি বাজাচ্ছিলনা। সবার মাঝে মাঝে হাঁটছিল। তাকে একটু কেমন জানি রবিনের মত লাগল। একটু পরেই নিঝুম আপন মনে হাসল। ধুর! তা কি করে হতে পারে! সে তার ফোনটা হাতে নিয়ে রবিনের নাম্বারটিতে আবার কল দিল। সাথে সাথেই অপাশ থেকে ভেসে আসল, “এই মুহুর্তে কলটি সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। THE NUMBER YOU DIALED IS SWITCHED OFF. “

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?