রেডিও জকি - অরণ্য রাত্রি



গাড়ি চালাচ্ছি হাইওয়ে তে। ঢাকা চিটাগাং হাইওয়ে তে। ঘুম কাটানোর জন্য কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে নেমেছিলেম চা খেতে। আমার প্রায়ই ব্যবসার কাজে চিটাগাং যাওয়া লাগে। মাঝে মাঝে আমি আমার গাড়ি নিয়ে চলে যাই। রেডিও ছাড়লাম। এই সময় আমার খুব প্রিয় একটি অনুষ্ঠান হয়। গানের অনুষ্ঠান। অনুরোধের আসর। যে এই প্রোগ্রাম যে উপস্থাপনা করে তার কণ্ঠস্বর অসম্ভব সুন্দর। আমি কণ্ঠস্বরের প্রেমে পড়েছি। এখন শুধু কণ্ঠস্বর নয় তার উপস্থাপনার ঢং ও আমি অসম্ভব পছন্দ করি।অযথা ইংলিশ বলার স্বভাব নেই। আজকাল বাংলা বলার মাঝে মাঝে ইংলিশ বলা ফ্যাশন হয়ে গিয়েছে। ছেলেটির নাম নাবিল।

আজ ছাড়লাম রেডিও । নাবিলের গলা।
“প্রিয় শ্রোতা শুরু করছি আমাদের সঙ্গীত অনুষ্ঠান অনুরোধের আসর। আপনারা সবাই জানেন আমাদের এই অনুষ্ঠানটি সাজানো হয় অনুরোধের গান নিয়ে। আর অনুরোধ করতে চাইলে এখুনি আপনার প্রিয় গান এবং গায়কের নাম লিখে আপনার মোবাইল ফোন থেকে এসএমএস পাঠান ৪০০০ নাম্বারে। এছাড়া আপনাদের মনের কথা, অভিজ্ঞতা কিংবা কবিতার লাইন যদি আমাদের সাথে শেয়ার করতে চান তাহলে এখুনি এসএমএসে এর মাধ্যমে লিখে ৪০০০ নাম্বারে পাঠিয়ে দিন। মেসেজে অবশ্যই নাম উল্লেখ করবেন”
আমি শুনছি আর মুগ্ধ হচ্ছি । এত ভরাট গলা। গান গাইলে নিশ্চয় অনেক সুন্দর হতো ।আমার মাঝে মাঝেই এসএমএস করতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু করা হয় না। শুনছি রেডিও আর গাড়ি চালাচ্ছি । তন্ময় হয়ে শুনছি।
গান হচ্ছে । ইচ্ছে করছে মেসেজ পাঠাতে । কিন্তু কি লিখবো ?গাড়ি এক পাশে রেখে মেসেজ লিখলাম।
“ আমি রাকিব। মিরপুর থাকি ।আপনার কণ্ঠস্বর খুব সুন্দর । আপনি গান গান না কেন?”
আবার গাড়ি চালানো শুরু করলাম। আমার মেসেজটি পড়বে তো ? আবার রেডিও ছাড়লাম । গান শেষ হয়েছে এখন ।
মেসেজ পড়া হচ্ছে।আমার টা পড়বে তো । এইতো আমার টি পড়া হচ্ছে ।
“মিরপুর থেকে রাকিব লিখেছেন ‘আপনার কণ্ঠস্বর খুব সুন্দর। আপনি গান গান না কেনও’ ধন্যবাদ আপনাকে আমার কণ্ঠস্বরের প্রশংসা করার জন্য”
এরপর ছেলেটি আরেকটি মেসেজে চলে গেলও। আমি অবাক হলাম আমার দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব দিল না কেন? আমি আবার মেসেজ পাঠালাম। জানি এই মেসেজের জবাব আসবে না। তারপরও পাঠালাম।
“রাকিব মিরপুর থেকে। আপনি আমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিলেন না”
উত্তর আসলো
“প্লিজ আপনারা একান্ত ব্যক্তিগত প্রশ্ন করবেন না। রাকিব ভাই আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না। আমাকে অসংখ্য মেসেজ পাঠান । কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু প্লিজ ব্যক্তিগত প্রশ্ন করবেন না”
প্রায় বাসায় চলে এসেছি। অনুষ্ঠান প্রায় শেষ । আমি শেষ বারের মত একটি সরি লিখে মেসেজ পাঠালাম। রাতটা ভাল গিয়েছে আরজে নাবিলের সাথে। মাসে ৪-৫ বার আমার চিটাগাং এ যাওয়া লাগে। পুরো রাতের জার্নি আমি নাবিলের কথা শুনতে শুনতে যাই।অসংখ্য মেসেজ পাঠাই । সাধারণত গানের অনুরোধ করি । কক্ষনো নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। এভাবেই নাবিলের সাথে সময় কাটতে লাগলো ।
এদিকে আমার নাম মোটামুটি ওই শো যারা শুনে তাদের পরিচিত হয়ে গেলো। কারন আমি অনেক মেসেজ পাঠাই। আর নাবিল আমার সব মেসেজ পড়ে। আমার মাঝেই মাঝেই ইচ্ছা করে নাবিল কে দেখতে। কিন্তু কিভাবে দেখবো।রেডিও অফিসে গেলে হয়তো তার ঠিকানা পাবো । কিন্তু আমি শুধু মাত্র ভক্ত হিসেবে দেখা করতে চাই না। অনেক ভালো বন্ধু হতে চাই। কিন্তু দিন চলে যাচ্ছে । কিভাবে বন্ধু হবো। মেসেজের মাধ্যমে কি বন্ধুত্ব আহবান জানানো কি ঠিক হবে? আমি দোনো মনো তে ভুগতে লাগলাম ।
এদিকে আমার জীবনের একটি গোপন অধ্যায় হল আমি সমকামী ।সেটা তো জানা তো জানানো যাবে না। কিন্তু সত্য গোপন করা কি ঠিক হবে? এরকম হাজারো চিন্তা মাথায় আসে।



একদিন মাথায় বাজ পড়লো । চিটাগাং থেকে ঢাকা আসছি। রেডিও ছাড়লাম । নাবিলের পরিচিত কণ্ঠস্বর । কিন্তু কেমন জানি দুঃখ মিশ্রিত কণ্ঠ। সব সময়ের মত প্রাণোচ্ছল নয়। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম কারন টি কি।
প্রিয় শ্রোতা আজ আমার আপনাদের সাথে এই প্রোগ্রামে শেষ পর্ব । আগামী কাল থেকে আরেক জন আসবেন এই জায়গায়। আশা করি আমার পরবর্তী আরজে কে আপনারা আমার মত গ্রহণ করবেন।

অনেক মেসেজ আস্তে লাগল। আজকে গানের চেয়ে নাবিল মেসেজ পড়ছে বেশি। এদিকে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। নাবিলে এই প্রোগ্রামে না থাকলে তো নাবিলের সাথে সকল সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে। নাবিলে এই কণ্ঠস্বর আর শোনা হবে না। তাকে আর মেসেজ পাঠাতে পারবো না। কারন নাবিলের ঠিকানা ফোন নাম্বার আমার কাছে নাই । আমি ভাবতে লাগলাম কি করবো ? ভাবলাম নাবিল কে শেষ বারের মত রেডিও তে নক করি। অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাবে। তাড়াহুড়ো করে লিখলাম
“প্রিয় নাবিল। তোমার কণ্ঠ আজকের পর রেডিও তে আর শোনা যাবে না। কিন্তু তুমি কি জানো ? তোমার ভরাট কণ্ঠস্বর আমার কত প্রিয়? তুমি কি জানো তোমার কথা বলার ঢং শুনে আমি তোমার কত বড় ভক্ত হয়ে গিয়েছি । তুমি রেডিও থেকে চলে যাবে । তার মানে আমার জীবন থেকেও চলে যাওয়া । এইটাই আমার শেষ মেসেজ তোমার কাছে। আমি কি কোন ভাবে তোমার বন্ধু হতে পারি? আমার মোবাইল নাম্বার ০১৭১.........।তোমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছি”

নাবিল মেসেজটি পড়লো না। আমি হতাশ। শেষ প্রোগ্রাম। আমি হতাশ হয়ে রেডিও বন্ধ করে দিলাম।আমার খুব অস্থির লাগছিল । গাড়ি রেখে হাইওয়ের ধারে দাড়িয়ে রইলাম। অসংখ্য গাড়ি আর বাস চলছে রাস্তায়। আমি ভাবছি নাবিলের কথা। আকাশে এক বিন্দু মেঘও নেই। তারা দেখা যায়। এলো মেলো চিন্তা মাথা আসছে। নাবিল কি আমাকে ফোন করবে? আজকে কি তার সাথে কথা হবে?অনেকক্ষণ বাইরে ছিলাম। এখন না রওনা দিলে অনেক রাত হয়ে যাবে। গাড়ি তে উঠলাম। বাসায় পৌঁছলাম ।কিন্তু নাবিলের ফোন তো আসে না।

দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলো । কিন্তু কোন ফোন আসে না।আমি আশা ছেড়ে দিলাম।একদিন আমার খালার বাসায় বেড়াতে আসলাম।আমার কাজিন নিলা পড়ে ক্লাস টেনে । সারা রাত ভর রেডিও শুনে। কথা প্রসঙ্গে জানতে চাইলাম আরজে নাবিলের সম্পর্কে। নিলা মিডিয়া সম্পর্কে যত ম্যাগাজিন আছে সব পড়ে। তার কাছে নাবিলের সম্পর্কে জানলাম। নাবিল নাকি খুব একটা স্মার্টলি কথা বলতে পারে না। শ্রোতার সংখ্যা কমে যাচ্ছিলো। তাই তাকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে। আমার মত নিলাও নাবিল কে খুব পছন্দ করে। হটাত এক চিলতে আলো পেলাম যেন। নিলার ফেইসবুক একাউন্টে নাবিল ফ্রেন্ড। নিলার মাধ্যমে নাবিলের ফেসবুকে ঢুকলাম।অবাক ব্যাপার ফেসবুকে নাবিলের কোন ছবি নেই। ফোন নাম্বারও নেই। কিন্তু ইমেইল এড্রেস রয়েছে।
আমি ভাবলাম ইমেইল পাঠাবো। কিন্তু আমার ইমেইলের জবাব দিবে তো ?খুব অশান্তি তে ভুগতে লাগলাম। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত মনঃস্থির করলাম ইমেইল পাঠাবো।

সারা রাত জাগলাম । কিন্তু কি লিখবো। অনেক ভেবে চিন্তেও কোন কথাই পছন্দ হচ্ছে না। পরে একটা খুব সাধারণ মেসেজ পাঠালাম।

“রাকিব মিরপুর থেকে? চিনতে পারছো ? আমি তোমার কণ্ঠস্বরের অসম্ভব ভক্ত। আমরা কি বন্ধু হতে পারি না?”
আমি ইমেইল পাঠিয়ে ঘুম দিলাম। শীত এর সকাল । ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। আম্মুর ডাকে উঠতে হল। ঘুম থেকে উঠেই মনে পড়লো ইমেইল এর কথা। চেক করলাম। রিপ্লাই এসেছে। ভোর ৪ টা সময় এসেছে মেইলটা।
“আমি আপনা কে চিনবো না? আমার রেডিও জীবনে যদি এক জন কারো নাম উল্লেখ করতে হয় তার নাম হবে আপনার নাম। আপনার অনুরোধ , প্রশংসা সব কিছু আমার অসম্ভব ভাল লাগতো। কিন্তু যোগাযোগের কোন উপায় ছিলও না। তারপর যেদিন আপনি আমাকে আপনার ফোন দিলেন তখন আমি মানসিকে ভাবে বিপর্যস্ত ছিলাম। তাই আপনাকে ফোন করতে পারি নাই। যখন সব কিছু সামলে উঠলাম তখন আর ফোন করা হয় নাই। ভেবেছিলাম অনেক দিন তো হয়ে গেল। আপনি নিশ্চয়ই ভুলে গিয়েছেন। আজকে আপনার মেইল পেয়ে যতটা খুশি হয়েছি ততটাই অবাক হয়েছি।এত দিন পরো আমাকে মনে রেখেছেন।আমিও আপনার বন্ধু হতে চাই।আপনার বন্ধুত্বের হাত ধরতে চাই”

মেইল টা এক নিঃশ্বাস এ পড়লাম। আবার পড়লাম। তাও মন ভরে না।খুব খুশি লাগছে আমার। কিন্তু খুশি ভাগ করার মত তেমন কোন বন্ধু নেই।তাতে কি আমি আজকে নিজেই আনন্দ করবো। সারা দিন। আমার সঙ্গী বিহীন ডেট। পরিপাটি হয়ে বের হলাম।
প্রথম গেলাম পার্কে বেলুন ওয়ালা বেলুন বিক্রি করবে। আমি সব গুলো বেলুন কিনে নিলাম। উড়িয়ে দিলাম আকাশে।মনে হচ্ছিলো আমি অনেক অনেক সুখী মানুষ। নিজের আনন্দ , সুখ প্রকাশ করলাম বেলুন উড়িয়ে দিয়ে। দেখলাম বেলুন ওয়ালা হাসছে। আমার খুশি দেখে হাসছে।
ভাই আজকে অনেক খুশী ?
হ্যাঁ ভাই।
কেন ভাই , ভাবীর জন্য বুঝি?
আমি হেসে বললাম
হ্যাঁ । মনে মনে বললাম ভাবী তো না।ঐ জায়গায় হবে ভাই।

সিনেমা দেখবো । পপকর্ন নিয়ে সিনেমা দেখতে ঢুকলাম ।কিন্তু হটাত মন খারাপ হয়ে গেলো । সবাই কাপল অথবা বন্ধু বান্ধব , পরিবার নিয়ে এসেছে। আমি একা। আমি খুব নিঃসঙ্গ। আমার সাথে নাবিলের কোন দিন দেখা হবে কিনা তারই ঠিক নাই। আমি আগে আগে কত কিছু ভেবে নিচ্ছি । আমি কেন এত কল্পনা বিলাসী। আমার খুব মন খারাপ হয়ে গেল। সিনেমা পুরোটা দেখলাম না। অর্ধেক দেখে বের হয়ে আসলাম।
বাড়ি চলে আসলাম। শাওয়ার নিয়ে শুইলাম।শুয়ে শুয়ে নাবিলের কথা ভাবছি । চোখটা বন্ধ হয়ে আসছিলো ।তন্দ্রা চলে এসেছে। হটাত মোবাইলের শব্দের চমকে উঠলাম। একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এসেছে।

হ্যালো?
ওপাশ থেকে একটি পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পেলাম।আরে এতো নাবিল। আরজে নাবিল। মন নিমিষে ভালো হয়ে গেলো।শুধু ভাল বললে ভুল হবে। অত্যধিক ভালো।সারাদিনের সব কষ্ট ভুলে গেলাম।কথা হল অনেকক্ষণ । নিজেদের জীবনের কথা , ভাল লাগার কথা। নাবিলের কণ্ঠস্বরের জাদু আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলো। আমার মনে হল নাবিলেরও আমার সাথে কথা বলতে ভাল লাগছে । সে সাবলীল ভাবেই আমার সাথে কথা বলছিল।

এরপর থেকে প্রতিদিন কথা বলি । রাতেই বেশি কথা হয়। নিজেদের জীবন নিয়ে কথা হয়। কিন্তু তখনো আমি জানি না সে সমকামী কিনা। এই প্রসঙ্গ কখনই উঠেই না।কিন্তু একদিন সে কথাটা তুললো ।
-তোমাকে আমার জীবনের একটা গোপন কথা বলা হয় নাই। আমার মনে হয় তোমাকে কথাটা বলা উচিৎ।
-বল
আমরা আপনি থেমে তুমি তে চলে গিয়েছি অনেক আগেই।
-এই কথাটা শোনার পর তুমি হয়তো আর আমার সাথে আর সম্পর্ক রাখবা না।
আমি হাসলাম আর বললাম
-শুনি দেখি তোমার গোপন কথা।
-আমি সমকামী
কথাটা শুনে আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছিনা। বললাম
-এই একই কথা তো আমিও কয়েকদিন যাবত বলতে চাচ্ছিলাম। আমিও সমকামী।
সেদিনের পর থেকে আমাদের মাঝে ঘনিষ্ঠতা আরও বেড়ে গেলো। এখন দেখা করার পালা। আমি তুললাম দেখা করার কথা। সেও রাজি হয়ে গেলো সাথে সাথে। আমি ঠিক করলাম যেদিন দেখা হবে সেদিনই তাকে প্রপোজ করবো। ঠিক করলাম মিট করবো একটি রেস্টুরেন্ট এ। আমি একডজন লাল গোলাপ নিলাম। পরলাম সাদা রঙের পাঞ্জাবী। রেস্টুরেন্টে এসে বসলাম। ওর আসার নাম নেই। ফোন করলাম বলল রাস্তায় আসছে। কিছুক্ষণ পর একটা স্মার্ট ছেলে কে ঢুকতে দেখলাম। গায়ে লাল রঙের টি শার্ট আর কালো জিনস। সরাসরি আমার টেবিলে এসে বসলো ।

-হাই আমি নাবিল।তুমি নিশ্চয় রাকিব।
এই তাহলে আমার প্রতীক্ষিত মানুষ। কিন্তু এতো চেনা চেনা লাগছে কেন? কোথায় যেন দেখেছি। আমি লজ্জা পাচ্ছিলাম। গোলাপ ফুল গুলো হাতে দিলাম। নাবিল স্বাভাবিক ভাবে ফুল গুলো নিলো। তারপর যা করলো তা অভাবনীয়। সে ফুল গুলো ডাস্টবিনে ফেলে এলো। আমি পুরো হকচকায়ে গেলাম।
-রাকিব এখনো তুমি আমাকে তুমি চিনতে পারছো না?আমি তো একবার দেখেই চিনে ফেললাম
আরে তাই তো। এ তো আমার পরিচিত একজন। আমার স্কুলে পড়তো রিয়াসাত হোসেন নাবিল। আমরা রিয়া বলে ডাকতাম। ভাবতে ভাবতে চলে গেলাম সেই স্কুল জীবনে।



রিয়াসাত আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়েছিল ক্লাস এইটে। বয়ঃসন্ধি এর সময়। তখন মানুষের শারীরিক এবং মানসিক ভাবে একটি পুরুষ অথবা নারী হিসেবে পূর্ণতা লাভ করে।কিন্তু রিয়ার শারীরিক ভাবে পুরুষের সকল বৈশিষ্ট্য থাকলেও মানসিক ভাবে যেন একটি মেয়ে হয়ে যাচ্ছিলো। সে হাঁটতো মেয়েদের মত। কথা বলতো মেয়েদের মত। আমি ছিলাম ক্লাসের নেতা গোছের। স্যার দের নামে আজেবাজে কথা বলে সবাই কে মজা দেয়ার কাজ টা বরাবর আমি করতাম। রিয়া আমার সামনের সিটে বসতো। তাকে নিয়ে মজা করলে দেখলাম সবাই ভারী মজা পায়। এটা আমার নতুন খেলা হয়ে গেলো। তার নতুন নাম দিলাম হাফ লেডিস। এই নামে ডাকলে সবাই খুব মজা পেতো। আস্তে আস্তে সবাই তাকে হাফ লেডিস ডাকা শুরু করলো। এটা যে নিষ্ঠুরতা তা আমি বুঝতে পারলাম না।আর এই বয়সের ছেলেরা একটু নিষ্ঠুর হয়। রিয়া কে জ্বালানোর জন্য নতুন নতুন কৌশল আমি আবিষ্কার করতাম। তার গায়ে পানি ছিটানো , শার্টে চুইংগাম লাগানো , খাতা ব্যাগ লুকিয়ে রাখা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। মাঝে মাঝে সে কেঁদে দিতো । কাঁদলে আমরা আরও বেশি মজা পেতাম। বুঝতাম না এটা আমাদের জন্য খেলা কিন্তু তার জন্য মরণ।

বছর শেষে স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। প্রতি শ্রেণী থেকে গান গাওয়ার জন্য নাম দিতে বলা হল।প্রতি শ্রেণী একজন নির্বাচিত হবে গান গাওয়ার জন্য। আমার তখনকার প্রাণের বন্ধু অপু নাম দিলো।অপু ভালো গায়। ক্লাসে আর কারো সাহস ছিল না আমার আর অপুর বিরুদ্ধে যেয়ে অপুর বিপক্ষে গান গাওয়ার জন্য নাম দেয়ার।কিন্তু যখন নির্বাচিত হল যারা তাদের তালিকা প্রকাশ করা হল তাতে অপুর নাম নেই। তাহলে আমাদের অষ্টম শ্রেণী থেকে নির্বাচিত হল কে?আর কেউ তো নাম দেয় নাই। তালিকা তে অষ্টম শ্রেণী থেকে যে নির্বাচিত হয়েছে তা দেখে আমার চোখ কপালে উঠে গেলো। এ আর কেউ নয় রিয়াসাত।
রাগে আমার আর অপুর পিত্তি জ্বলে গেলো। রিয়ার এতো সাহস। তাকে শিক্ষা দিতেই হবে। ঠিক করলাম এখন কিছু বলবো না। অনুষ্ঠানের দিন মজা বুঝানো হবে।

অনুষ্ঠানে আমরা আগে আগে যেয়ে সামনের দিকে বসলাম। পুরা শ্রেণীর যারা আমার সঙ্গী তারা সবাই এসেছে। সবার হাতে পচা ডিম দিলাম। রিয়াসাতের গান শুরু হতেই আমরা ডিম নিক্ষেপ শুরু করলাম। বেচারা তো গান গেলোই না। দৌড়ে স্টেজ থেকে নেমে গেলো। আমরা তো হাসতে হাসতে শেষ । যাক রিয়া কে উচিৎ শিক্ষা দেয়া হল।

বাড়ি যাওয়ার পথে দেখলাম একটি গাছের আড়ালে বসে রিয়াসাত কাঁদছে।খুব অসহায় লাগছে তাকে। চোখ মুখ কেঁদে ফুলিয়ে ফেলেছে।আমাকে দেখে ভয়ার্ত দৃষ্টি তে তাকালো।আবার যদি আমি কিছু করি এই ভয় পাচ্ছে সে। এই প্রথম আমার কেমন জানি কষ্ট হল। মনে হল আমি খুব বড় একটা অন্যায় করেছি। বাসায় যেয়েও আমি অপরাধ বোধে ভুগতে লাগলাম।
সেইদিন রাতে আমার জ্বর আসলো। টাইফয়েড ধরা পড়লো। ১ মাস অসুস্থ থাকলাম। বার্ষিক পরীক্ষা দিতে পারলাম না। সেই জ্বরের সময় আমার জেগে থাকার সময় টুকু কাটতো বই পড়ে।
আমি তখন মাত্র বয়ঃসন্ধি তে পড়েছি । মাত্র বুঝতে শুরু করেছি ব্যাপার গুলো । ক্লাসের সবাই মেয়েদের নিয়ে কথা বলে। অথচ আমার ভাল লাগে না এইসব। মেয়েদের প্রতি আমি কোন শারীরিক আকর্ষণ অনুভব করি না। আমার ভাল লাগে ছেলেদের কে। আমার খুব ভয় লাগতো। ভাবতাম আমি এমন কেন? একদিন লুকিয়ে লুকিয়ে বড় ভাইয়ার একটি প্রাপ্ত বয়স্ক বই নিয়ে পড়ছিলাম। সেখানে পেলাম সমকামিতার কথা।আমি যে সমকামী তা বুঝতে আমার সময় লাগলো না। মনে হচ্ছিলো আমি একা পৃথিবী তে এমন। কিন্তু সেই মুহূর্তে মনে হল রিয়ার কথা। সে নিশ্চয়ই সমকামী।তার মেয়েলি আচরণ তা প্রমাণ করে। আমার মনে খুব অপরাধ বোধ কাজ করতে লাগলো। আমি সমকামী তা জানলে আমার স্কুলের বন্ধুরা আমাকে ছেড়ে দিবে না। নিশ্চয়ই বিদ্রূপ করবে। মজা করবে আমাকে নিয়ে।কিন্তু আমি তো ইচ্ছে করে এমন হই নাই। আমার দোষ কোথায় ? ঠিক রিয়া তো ইচ্ছে করে মেয়েলি হয় নাই। আমার খুব খারাপ লাগতে লাগলো। মনে হল এবার স্কুলে যেয়ে রিয়ার কাছে মাফ চাবো। আমার খুব মায়া জন্মাল ছেলে টার উপর। শুধু মায়া না। আমি বুঝতে পারলাম আমার তার প্রতি একধরনের শারীরিক আকর্ষণ জন্মাচ্ছে। তার কথা ভাবলে আমার খুব ভাল লাগে। শরীর জেগে উঠে।একদিন স্বপ্নে রিয়া কে দেখলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি পাজামা ভেজা। না রিয়া কে আমার জীবনে লাগবেই। তাছাড়া এই দুনিয়ায় রিয়া ছাড়া আমার মত আর কাউকে তো চিনি না। তাই তাকে খুব আপন মনে হতে লাগলো
আমি অসুস্থ থাকায় বিশেষ বিবেচনায় নবম শ্রেণীতে উঠলাম। নবম শ্রেণীর প্রথম দিন ক্লাসে গেলাম। আজ মাফ চাবো রিয়ার কাছে। কিন্তু রিয়া নেই। ২ সপ্তাহ পার হল। রিয়া আর ক্লাসে আসে না। বুঝলাম রিয়া এই স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু কোন স্কুলে ভর্তি হল তা কেউ জানে না। রিয়া হারিয়ে গেলো আমার জীবন থেকে।আমার জীবনটা শূন্য করে দিয়ে গেল।অপরাধ বোধ আর হারানোর বেদনা প্রতিদিন আমাকে তিল তিল করে মারছিলো। কিন্তু সময়ের সাথে সব ভুলে যায় মানুষ। আর আমি তো তখন মাত্র কিশোর। ভুলে গেলাম রিয়া কে। কিন্তু তার সাথে আবার এভাবে দেখা হবে তা কল্পনাউ করি নাই কখনো।



নাবিলে ওরফে রিয়ার ডাকে কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসলাম আমি।
কি ব্যাপার? মনে পড়েছে ?
আমার প্রথমে ক্ষমা চাওয়ার কথা মাথায় আসলো। আমি তো অনেক বড় অপরাধ করেছি। স্কুল জীবন মানুষের জীবনের সবচেয়ে মধুর সময় আর আমি তো তার সেই সময়টা দোজখ বানিয়ে দিয়েছিলাম।
রিয়া আমি সেই সময় তোমার সাথে যে অন্যায় করেছি। তার জন্য ক্ষমা চাই।জানি অনেক বড় অপরাধ। তারপরও ...... আমি না বুঝে করেছি।
এত সহজ। ক্ষমা চাই বললা আর ক্ষমা হয়ে যাবে? আর খবরদার আমাকে রিয়া ডাকবা না। নাবিল বল।
নাবিল আমি তো তোমাকে সেই সময় আর ফিরিয়ে দিতে পারবো না। কিন্তু আমি সত্যি আন্তরিক ভাবে ক্ষমা চাই । তুমি জানো না তুমি যখন স্কুল ছেড়ে গেলে তোমাকে আমি অনেক খুঁজেছি শুধু ক্ষমা চাওয়ার জন্য।
মিথ্যে কথা।
আমি তোমাকে ভালোবাসি নাবিল
ভালবাসা মাই ফুট। তুমি জানো তুমি আমার কি ক্ষতি করেছো ?তুমি জিজ্ঞেস করেছিলা না আমি কেন গান গাই না? তাহলে শুনো আমার জীবনের এক মাত্র আনন্দ তুমি কেঁড়ে নিয়েছ ।গান ছিল আমার প্রাণ। কিন্তু সেদিনের পর থেকে আমি আর গান গাইতে পারি না। গান গেলেই সেইদিনের কথা চোখের সামনে ভাসতে থাকে। আর গান গাইতে পারি না। কি ক্ষতি করেছিলাম আমি তোমার ? এতো বড় ক্ষতি কেন করলা? আই জাস্ট হেইট ইউ।
নাবিল এই কথা গুলো বলে সোজা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেলো চোখ মুছতে মুছতে।আমি হতবাক।এতো ক্ষোভ আমার প্রতি। হবেই বা না কেন?আমি তো সত্যি তার জীবনের সবচেয়ে ভালবাসার জিনিস কেঁড়ে নিয়েছি।আমি শপথ নিলাম যেভাবেই হোক আমি নাবিলের জীবনের সব কষ্ট দূর করে দিব। কিন্তু কিভাবে? আমি অনেক চেষ্টা করলাম যোগাযোগ করার। কিন্তু তার মোবাইল অফ। বুঝলাম নাবিল আমার জীবন থেকে আবার হারিয়ে গেলো ।আমার জীবন টা আবার শূন্য হয়ে গেলো।



আমার কিছু ভাল লাগে না। সারাদিন মন মরা হয়ে থাকি। খারাপ লাগে বেশি রাতে।তখন চারিদিক চুপচাপ হয়ে যায়।একা লাগে তখন।সমস্ত পৃথিবী যেন তখন আমাকে বলে তুমি তোমার ভালবাসার মানুষের সাথে অনেক বড় অন্যায় করেছো। আমি পালাতে চাই নিজের বিবেকের কাছ থেকে। গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যাই। চলে যাই হাইওয়ে তে।রাতের আকাশ দেখি। তারা গুনি।যখন কষ্টের তীব্রতা বেড়ে যায় তখন কাঁদি একা একা। একদিন কি মনে হল।রেডিও অন করলাম। নতুন আরজে। নাম মিশু।হটাত মনে হল আচ্ছা আমি যেমন রেডিও শুনছি। নাবিলও কি শুনছে?আমার মনে হল শুনছে।গাড়ি থামিয়ে আমি একটা এসএমএস পাঠালাম। আমার মেসেজ পড়বে তো ?
এইতো পড়ছে ।
“মিরপুর থেকে রাকিব একটি মেসেজ পাঠিয়েছে। তিনি লিখেছেন
‘রিয়া আমি আমার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাই । আর আমি তোমাকে সত্যি ভালবাসি’
রিয়া আমিও রাকিবের হয়ে আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। আর আমরা সবাই চাই। কি বলেন লিসেনারস?রিয়া আপনি রাকিবের ভালবাসা গ্রহণ করুন। আমাদের সবার অনুরোধ”
কিন্তু কোন উত্তর আসলো না।
সেদিনের পর থেকে আমি প্রতিদিন মেসেজ পাঠাতে থাকলাম। আর প্রতিরাতেই আমার মেসেজ পড়া হতে লাগলো।
আগামীকাল ভ্যালেন্টাইন্স ডে।এইবারও একা কাটাতে হবে। আমি আজকে শেষ মেসেজ পাঠাবো। আজ উত্তর না আসলে আর পাঠাবো না। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে আজ উত্তর আসবে।মেসেজ পাঠিয়ে হাইওয়ের ধারে গাড়ি থামিয়ে বসে রইলাম। আকাশ পরিষ্কার। কোন মেঘ নেই। তারা গুনছি আমি।উত্তর আসবে তো ?
অনুষ্ঠানের প্রায় শেষ পর্যায়। উত্তর আসে নাই। আমি হতাশ। মিশু বলছে
আমি শেষ মেসেজ পড়তে যাচ্ছি আজকের মত।

ওয়াউ। লিসেনারস চমক অপেক্ষা করছে আপনাদের জন্য আর মিস্টার রাকিবের জন্য। আপনারা তো জানেন রাকিব ভাই আমাদের প্রোগ্রামে প্রতিদিন একই মেসেজ পাঠিয়ে যাচ্ছেন । আজ তার উত্তর এসেছে। আমি এই কথা শুনে এক কথায় ভয়ে পাথর হয়ে গেলাম। কি উত্তর দিলো
“রাকিব আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি। তুমি কালকে সকাল দশটায় ধানমন্ডিতে আমার সবচেয়ে প্রিয় রেস্টুরেন্ট টা তে থাকবে। আমি আসবো। তোমার হাতে যেন এক গুচ্ছ লাল গোলাপ থাকে”
আমার চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। আমার আনন্দ অশ্রু।

পরিশিষ্ট
এখন আমি আর নাবিল এক সাথে থাকি। প্রেম ভালবাসা আর খুনসুটি নিয়ে চলছে আমাদের সংসার।

৪টি মন্তব্য:

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?