শুভ বিবাহ

“রেইপ ইজ এ সারপ্রাইজ সেক্স।” – জনৈকা বলিউড অভিনেত্রী। ১. শুভ দৌড়াচ্ছে। প্রথমে গুটি গুটি পায়ে দৌড় শুরু করলেও এখন লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে দৌড়াচ্ছে। শুভ সেনগুপ্ত। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাসাহিত্যে পড়া শেষ করে মাস তিনেক হলো জবে ঢুকেছে। গুল্টু গুল্টু চেহারা আর সুমিষ্ট কন্ঠস্বরের জন্য অফিসের সবাই তাকে পছন্দ করে। বস ম্যাডাম তো কারণে অকারণে সময়ে অসময়ে তার প্রাইভেট চেম্বারে ডেকে পাঠান। এই নিয়ে অফিসের অনেকেই অন্দক সময় তাকে ঠারে ঠারে কিছু বলার চেষ্টা করলেও সে পাত্তা দেয়নি। সে জানে সব অফিসেই এমন কিছু লোক আছে যারা অন্যের ভালো সহ্য করতে পারে না। অন্যের উন্নতিতে হৃদ মাঝারে শ্লাঘার ভূমিকম্পে অনুভাবিত হয়। শুভ সেনগুপ্ত দৌড়াচ্ছে। কালো সাদা লাল সব ঘাম এক যোগে ছুটছে। ঘন্টায় সাড়ে সাইত্রিশ মিলি মাইলস বেগে। তার পিছে ছুটছে তিন উর্বশী। রম্ভা মেনকারা নয়। এরা ধরিত্রীর তিন উর্বশী। মায়ে খেদানো বাপে তাড়ানো তিন কন্যা। সানি লিয়ন, শ্রাবন্তী এবং শাবনুর। এলাকা জুড়ে তাদের সুখ্যাতি বলো আর কুখ্যাতি বলো তা প্রায় রূপকথার গল্পের মত রূপ পেয়েছে। উঠতি বয়সী ছেলেরা তাদের নাম শুনলে ভয়ে ভিমরি খায়। তাদেরকে রাস্তায় দেখা মাত্র তারা পাশের কোন গলিতে ঢুকে পড়ে। এই তিন কন্যার দিন কাটে বয়েস স্কুলের সামনে আড্ডা পিটিয়ে। অভিভাবকদের অভিযোগে অতিষ্ঠ হয়ে হেডমাস্টার হারাধন হালদার বারকয়েক চেষ্টা করে ক্ষান্ত হয়েছেন। সরকারী দলের মন্ত্রী মিনিষ্টার কারো স্নেহের আঁচল রয়েছে এই তিন কন্যার উপর। তাই হারাধন বাবু বেঘোরে কিংবা ডেংগু জ্বরে নিজের মাতৃদত্ত প্রাণখানা যাতে না হারান সেজন্য একদম বরফির মত মিউট হয়ে গেছেন। একদিন বিকেল ছুঁইছুঁই করছে সূর্য দেবের হাতঘড়ি এমনি সময়ে ছাতা মাথায় ধুতির কোঁচা হাতে হারামনি দেবীর জেষ্ঠধন হারাধন হালদার স্কুলের গেট থেকে যেইনা বেরিয়েছেন অমনি সানি লিয়ন তো এয়সা সিঁটি বাজিয়ে দিলো দুই ঠোঁটের মাঝে যে দমকল বাহিনীর সাইরেনের ডেসিবেলও ফেল মেরে গেলো। শুভ দৌঁড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে সে ইংরেজী হেল্প, বাংলায় বাঁচাও বলে সর্বোচ্চ ফ্রিকোয়েন্সিতে চিৎকার করছে। বারকয়েক তো হেল্প উচ্চারণ তামিল কি তেলেগুদের মত হেল্পা শোনা গেলো। কেউই যে শোনেনি এমন নয়, কিন্তু কে আসবে সাহস করে আপন মাতৃদত্ত প্রাণখানা হারাতে। ঢাকাইয়া সিনেমায় এমন সময়ে সুন্দরী কোন নায়িকা বুক ফুলিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। ভিলেইনাদের আচ্ছামত ধোলাইখালে ফেলে ধোলাই করার মত ইয়া ঢিসুম ঢিসুম দিয়ে বেচারা নায়কের ইজ্জত সম্মান রক্ষা করে। অতঃপর ঢিংকা চিকা নাচের সাথে তু দেখা মেরা আখি টাইপ গান গেয়ে প্রেম হয়ে যায়। শুভও আশা করছিলো আজ এমনি কোন নায়িকা এসে তার সম্ভ্রম রক্ষা করুক। কিন্তু নিয়তি হয়তো খারাপ। নায়িকারা অন্য কোথাও অন্য কোন নায়ককে বাঁচাতে অথবা নাচাতে ব্যস্ত। নাহলে যে ময়দানে নিত্যি রাসমেলার ভিড় জমে থাকে আজ সেখানে কেন নিস্তব্ধ সন্ধ্যা। কিসে যেন উষ্ঠা খেয়ে পপাত ধরনীতল। একরাশ ধুলো এসে মুখে ফেস পাউডার ছিটিয়ে দিলো শুভর মুখে। তিন কন্যাও চলে এসেছে। শ্রাবন্তী শুভর জামার কলার ধরে টেনে তুললো। শুভ খুব ভয় পেয়ে গেলো। পটাং করে টপ বোতাম ছিড়ে গিয়ে ডাইভ দিয়ে ঘাসের আড়ালে গিয়ে লুকালো। সে কোথায় যেন পড়েছিলো বাজে মেয়েরা জোর করে ছেলেদের সাথে ঐসব করার আগে এভাবে জোর করে জামা ছিড়ে ফেলে। হায় হায়। সে এই ছেড়া জামা গায়ে কিভাবে এখান থেকে বাড়ি যাবে। সবাই তাকে কলংক দেবে। মা বকবে, বাবা কাঁদবে। তাকে হয় গলায় দড়ি দিতে হবে অথবা গঙ্গায় ডুবে মরতে হবে। এত অল্প বয়সে তার মরার কোন ইচ্ছে নেই। কিন্তু কাহিনীতে যদি তার মৃত্যু লেখা থাকে তবে কি বাঁচার উপায় আছে। আচ্ছা গঙ্গার লাফ দিয়ে পড়লেই দেখা যায় নায়কেরা মরে যায়। সে যদি হাওড়া ব্রিজ থেকে লাফিয়ে পড়ে তবে কি মরবে। সে তো সাঁতার জানে। সাঁতরে কি গংগার ওপারে চলে যেতে পারবে। অথবা গঙ্গা দিয়ে সাতার কাঁটতে কাঁটতে সে বাংলাদেশে চলে যাবে। গংগাই তো ওপারে পদ্মা নামে পরিচিত। শ্রাবন্তী তার কলার ধরে ঝাকাচ্ছে। দৌঁড়ালি কেন? শাবনুর কাঁধ শ্রাগ করে বললো আস্তে। দেখ না ভয় পেয়ে গেছে। ফার্মের মোরগগুলোর মত আবার হার্টফেল না করে বসে। ফার্মের এক মোরগের নাকি একশো মুরগীকে হোমসার্ভিস দিতে হয়। এই তিন কন্যাও কি !!!! সে কেঁদে ফেললো। আমাকে ছেড়ে দাও। প্লিজ। আমি তোমাদের হাত ধরছি। পায়ে পড়ছি। প্লিজ আমার কোন ক্ষতি কোরো না। বাড়ি যেতে দেরি হলে মা বকবে। বাবা চিন্তা করবেন। সানি জিজ্ঞেস করলো, আমি তোকে ডাকলাম। আর তুই দৌঁড়ালি কেন? শুভ তোঁতলাতে তোঁতলাতে বললো, ভয়ে। শ্রাবন্তী অবাক হয়ে শুধোলো, ভয়ে, কিসের ভয়ে? শুভ কোন উত্তর দিতে পারলো না। মুখ নিচু করে রইলো। শাবনুর হু হা হা করে অট্টহাসি দিয়ে বললো, ইজ্জত লুটের ভয়ে? আমাদের আর খেয়ে দেয়ে কোন কাজ নেই তোর মত চিংড়ি মাছের ইজ্জত লুট করে বেড়াবো। ক্লা্স অফ ক্লানে আমি অনেক কিছুই লুট করি। পাশ থেকে সানি ঠিক করে দেয় আরে এইটা ক্লাস নারে ক্লাশ। শ্রাবন্তী চোখ মেরে বলে হ্যাঁ সানি তো আবার এইসব ক্লাশিং ওয়ার্ড ভালো বোঝে। সানি এগিয়ে এসে শুভর গুল্টু গুল্টু গালে দুটো ঠোনা মেরে বললো, যা। বাড়ি যা। আজ সারাদিন কেমন যেন গা ম্যাজ ম্যাজ করছিলো। তাই তোর সাথে আমরা মজা করলাম। আমাদের ভয় করার কিছু নেই। আমরা অত খারাপ নই। তিনকন্যা কাঁধ ধরাধরি করে সিঁটি বাজাতে বাজাতে দৃশ্যপট থেকে বেরিয়ে গেলো। শুভ অবাক হয়ে তখনো ফাঁকা ময়দানে দাঁড়িয়ে আছে। সূর্যিমামা ঘুমিয়ে পড়ায় আস্তে আস্তে সব আলো নিভে আসছে। 

শুভ বিবাহ – ০২: টেনশান এরাইজেস!
কে দেখেছে কে দেখেছে,
দাদা দেখেছে
দাদার হাতে কলম ছিলো ছুড়ে মেরেছে,
উহ বড্ড লেগেছে! – বিখ্যাত বঙ্গীয় শিশুতোষ ছড়া।

উদয়শংকরপুর রোডে শুভ’র বড় মামা থাকেন। শুভর মা শুশীলা সেন এতক্ষণ বড়মামার সাথে কথা বলছিলেন। কথা শেষ করে গম্ভীর মুখে পায়চারী করতে লাগলেন। এমন সময়ে শুভর বাবা গোবিন্দ গুপ্ত চায়ের কাপ হাতে মঞ্চে প্রবেশ করলেন। ছত্রিশ ওয়াটের টিউবলাইটের আলোয় তার বিষাদে মেঘাচ্ছন্ন মুখখানা দেখা গেলো। কাঁপা কাঁপা গলায় শুশীলা দেবীকে বললেন, চা খাও। মেজাজ ঠান্ডা হবে।

কথাখানা শুনে শুশীলা সেনের মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেলো। গরম চা খেয়ে মেজাজ ঠান্ডা হয় কি করে। গরম তো গরমকে আরো উত্তপ্ত করে দেয়। ব্যাকরণের নিয়মানুসারে সেন এবং গুপ্তের সন্ধিবিচ্ছেদের ফলে সেনগুপ্ত শব্দ ধারণ করে। তবে শুশীলা এবং গোবিন্দের সকল মতের ব্যাপারে বিচ্ছেদ ঘটলে শুধুমাত্র শুভর ব্যাপারে সন্ধি করতে সমর্থ হয়েছেন।

শুভ ভেবেছিলো ব্যাপারটা কেউ জানেনি। কিন্তু বাতাস সংস্কৃতির এই যুগে তার শ্লীলতাহানির খবর চাউর হতে সময় নেইনি ন্যানোসেকেন্ড। বাড়ি থেকে অফিস, বৌবাজার থেকে শ্যামবাজার মায় লালবাজার পর্যন্ত সবার মুখেই আলোচিত হচ্ছে। মংগলবার মধ্যদুপুরে পুরুষাধিকার সংগঠন ‘পুরুষের জন্য’ লেগবুকে তাদের পেজে পুরুষবন্ধনের ডাক দিয়েছে ভিক্টোরিয়া পার্কে। বিভিন্ন সামাজিক এবং অসামাজিক মাধ্যমগুলোতে পুরুষনির্যাতনের এহেন ঘটনা নিয়ে আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইছে। বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত বিশিষ্ট পুরুষবাদী লেখক জনাব মসলিন খান তার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে সুবিশাল এক কলামে উল্লেখ করেছেন এমনটি যে ঘটবে সে তিনি অনেক আগে থেকেই জানতেন। পুরুষের অধিকার আদায়ে তিনি লড়াই করে চলেছেন। পৃথিবীতে অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি ঘর ছেড়েছেন, দেশ ছেড়েছেন। তার কলামের বিশাল অংশ জুড়ে নিজস্ব ব্যক্তিজীবনের বর্ণনা করে গেছেন। কিভাবে তিনি বারবার নারীদের হাতে লাঞ্চিত হয়েছেন, বঞ্চিত হয়েছে, তিরষ্কৃত হয়েছেন। পুরো ৩৬০০ ওয়ার্ডের পোস্টে শুভর নাম এসেছে সাড়ে দুইবার। একবার তিনি এক জায়গায় শু লিখেছেন। এটা দ্বারা তিনি জুতা বুঝিয়েছেন নাকি শুভকে বুঝিয়েছে তা পাঠকের কাছে স্পষ্ট নয়। লাল বাজারের সাদা উর্দিপরা দারোগা চন্ডীবালা চার কাপ চা খেয়ে শুভর জবানবন্দী নিয়ে গেছেন। চন্ডীবালার সারনেম কি শুভর জানতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু বুকে লাগানো নেমপ্লেটে শুধুই এটুকু লেখা ছিলো। তিনি আশ্বাস দিয়ে গেছেন ভবিষ্যতে বখাটে মেয়েরা যাতে তাকে উত্যক্ত না করে সে ব্যাপারে তিনি লক্ষ্য রাখবেন। শুভ জানে পুলিশ মানে হচ্ছে পাজি+লম্পট+শয়তান । এর ব্যতিক্রম সে কখনো কোথাও দেখেনি। পুরাতন জমানার পুঁথি সাহিত্যে অবশ্য পুলিশকে নিয়ে ভালো ভালো গাঁথা লেখা আছে। শুভ খুব টেনশানে পড়ে গেছে। তাকে কি এই দৃশ্যেই সুইসাইড করতে হবে। নাকি ফুটেজে আরো কিছুক্ষণ স্থান পাবে। সে কোন কিছুই বুঝতে না পেরে ঘরে দরজা লাগিয়ে চুপচাপ বসে আছে। জানালার বাহিরে খোলা আকাশ। একটু একটু করে সন্ধ্যা আসছে। তার খুব ইচ্ছে করছে এক দৌড়ে বাইরে চলে যেতে। মেয়েদের মত সাইকেল চালিয়ে একা একা ঘুরতে, হাওড়া ব্রিজের ওদিকে ফুচকা বিক্রি হয়। ফুচকাওয়ালীদের কাছ থেকে ফুচকা কিনে খেতে। কিন্তু সব চাওয়া এক জীবনে পূর্ন হয় না। মা তার চাকরিটাই ছাড়িয়ে দিয়েছেন। এখন থেকে ঘরের বাইরে যাওয়ার উপর ১৪৪ ধারা জারী করা হয়েছে।

চায়ে চুমুক দিয়ে শুশীলা দেবীর মেজাজ আরো তিরিক্ষি হয়ে গেলো। চোখ নাক কুঁচকে বললেন, বলি শ্যুগার কি বাংলালিঙ্ক দামে পাইছো যে চিনির বস্তা চায়ের কাঁপে টাইটানিকের মত ডুবিয়ে দিয়েছো। এইটা চা নাকি সরবত! এত বছরেও চা টা বানানো শিখলে না। বাড়ি বসে বসে করোটা কি!
শুভর বাবা মিনমিন করে বললো, কেন চিনি তো ঠিকই আছে।
শুশীলা সেন খেঁকিয়ে উঠলেন, আ মঁলো। তোমরা বাঙ্গাল দেশের লোক বোঝই টা কি। ঝাল নুন চিনির মাত্রা জ্ঞান আছে তোমাদের কোন?
পিতৃভূমি নিয়ে কথা বললে শুভর বাবা খুব কষ্ট পান। তার চোখে জল চলে এলো মেঘনার ঢলের মত। আহারে কি সুখের দিন না ছিলো সেই সময়। যদিও তার স্পষত মনে পড়ে না। ভাসা ভাসা স্মৃতি। তবুও সেগুলো ভাবতেই বুকের মধ্যে কেমন সুখ সুখ লাগে।
শুভর বাবা বীনার হঠাৎ ছিড়ে যাওয়া তারের মত কটাং করে বলে বসলেন, তোমরা রাঢ় অঞ্চলের লোক খাওয়া দাওয়ার বোঝোই ডা কি। তরকারীতে গুচ্ছের চিনি দিয়া থোও। পূর্ববঙ্গের মানুষেরা...
“আরে বন্ধ করোতো তোমার ভাঙ্গা ক্যাসেট। পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু শুনতে শুনতে কানটা ঝালাপালা হয়ে গেলো। সবার মুখে এক ডায়ালগ। যারা ঘটি বাটি বদনা নিয়ে বর্ডার পার হয়ে আসছো তাদের সবারই পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু ছিলো। একজনও কি গরীব ছিলো না! আর পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু তো সব ওইপারে রাইখা আসছো। তাহলে ওপারের মানুষগুলো সব বড়লোক হয়ে যায় নাই কেন। ওরাও কেন সুযোগ পাইলে মিডোলিস্টের মরুভূমিতে ঘাস কাটতে যায়! ছেলেটারে নিয়ে আছি মহা ঝামেলায়। আর তিনি আছেন নস্টালজিক ম্যুডে। শোন বড়দার সাথে কথা বললাম। এই ছেলেকে আর বেশীদিন ঘরে রাখা ঠিক হবে না। বিয়ে দিয়ে দিতে হবে।”!


 
শুভবিবাহ-০৩: ওপার বাংলা
কে মেরেছে, কে ধরেছে, কে দিয়েছে গাল।
তার সংগে গোসা করে ভাত খাওনি কাল।।
কে মেরেছে, কে ধরেছে, কে দিয়েছে গাল।
তার সংগে কোঁদল করে আসবো আমি কাল।। - ছেলেভূলানো ছড়া, লোকসাহিত্য, প্রবন্ধ, রবীন্দ্র রচনাসমগ্র।

জানুয়ারীর তেরো তারিখ। সন্ধ্যার অন্ধকার চাঁদরে ঢাকা পড়েছে চারপাশ। চন্দ্রদেব আজ ডিউটিতে আসতে দেরী করছেন নাকি অফ ডিউটিতে আছেন বোঝা যাচ্ছে না। এইসব খবর তারাই ভালো বলতে পারবেন যারা চন্দ্র সূর্যদেবের ডিউটি রোস্টারের খবরাখবর নিয়ে লেখা পঞ্জিকা নামক মাসিক ম্যাগাজিন পড়ে থাকেন। অন্ধকারের ভিড়ে রোডলাইটের নিচে এখানে ওখান ছোপ ছোপ আলো। ফুটপাতের পাশে একজায়গায় বেশ জটলা। শীতের দিনে গরম গরম পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা। দুজন পিঠা বিক্রেতা পিঠা বানিয়ে চলেছেন। কাঠের বেঞ্চিতে বসে ক্রেতারা গল্পগুজব করছে। পিঠা খাচ্ছে। যে পিঠা পাওয়ার জন্য সিরিয়ালে আছে সে ডিরেকশান দিচ্ছে, চাচা পিঠাটা আরেকটু শক্ত হোক তারপর নামান। চাচা সহাস্যে মাথা নেড়ে বলেন আচ্ছা। চারমুখো চূলোয় দুইহাতে পিঠা বানিয়ে চলেছেন সমান গতিতে। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ দোকানে বেশ ভিড়। বিক্রেতার নাম রইসুদ্দিন গাজী। রইস শব্দের অর্থ সম্ভ্রান্ত, বিত্তশালী। বাবা মা বুঝে নাম রেখেছিলো কিনা কে জানে! তবে রইসের জীবনে বিত্তের দেখা সেভাবে কখনো মেলেনি। সম্পদ বলতে তার তিন ছেলেই।

দুইধরণের পিঠা এখানে চলে ভালো। ভাঁপা পিঠা আর চিতই পিঠা। চিতই পিঠার সাথে সরিষা ভর্তা কি শুটকি ভর্তা দিতে হয়। ভাঁপা পিঠায় গুড় লাগে। রইসুদ্দিনের খেয়াল হলো তার গুড় ফুরিয়ে এসেছে। ভেবেছিলো গুড় যা আছে তাতে আজকে চলে যাবে। পাশে গদাধরকে ডেকে বলে, ও গদা দা, আমার গুড় ফুরিয়ে গেছে তোমার কাছে কি পাটালি আছে।

গদাধর হেসে বলে, আছে। নাও। আরে গত হপ্তায় তোমার কাছ থেকে একখান পাটালি নিছিলাম। বলবা না আগে। ভূলেই গেছিলাম।

দুজনের কথায় কিছুটা আঞ্চলিক টান আছে। রইসুদ্দিনের বাংলায় উড়িয়া ভাষার টান আর গদাধরের কথায় খুলনা সাতক্ষীরা অঞ্চলের টান স্পষ্ট। একদা ছুৎমার্গের ভারতবর্ষে এর ছোঁয়া খাবোনা, ও অচ্ছুৎ ওকে সমাজচ্যুত করো ইত্যাদি নানা উপসর্গে আক্রান্ত ছিলো। এখনো মাঝে মাঝে এই উপদ্রবকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে অনেকে ফায়দা লোটার ধান্দা করে। তবে আম আদমি মিশে গেছে জীবন স্রোতে। তারা কে চাচা আর কে কাকা তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। গদাধরের চেয়ে রইসুদ্দিনের পিঠে বানানোর হাত ভালো সেজন্য সবাই রইসুদ্দিনের চূলার সামনে ভিড় করে। রইসুদ্দিন দুটো ডিম বের করে গদাধরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, বাড়ির “কুকড়ো” ডিম পাড়া শুরু করছে। তোমার চাচী পাঠায় দেলো। পোলাটারে খাওয়াইয়ো।

এই ল্যাম্পোস্ট থেকে উত্তরের দিকের পরবর্তী ল্যাম্পোস্টের মধ্যবর্তী দূরত্বকে যোগ করে দুই দিয়ে ভাগ করে দেড় ফুট যোগ করলে শুভদের বাড়ির গেট দেখা যাবে। দোতলা বাড়ি। ফ্যাকাশে সাদা রঙ। একসময় হয়তো দুধ সাদা রং করা হয়েছিলো। বাড়িতে ঢোকার গেটটা গতবছর নতুন করে বসানো হয়েছে। গেটের একপাশে একটা বকুল গাছ অন্যপাশে কদম গাছ। গত আশ্বিনের ঝড়ে পুরোনো  কদম গাছটা কড়াৎ করে মাজা থেকে ভেঙে গেলো। এরপরে গোবিন্দ গুপ্ত শ্যামবাজারে তার পরিচিত মাধবীলতা নার্সারি হাউজ থেকে নতুন কদমের চারা এনে লাগিয়েছেন। এখনো সেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়াতে পারেনি গাছটা।
দোতলার দক্ষিন দিকের ঘরটা শুভর। শুভ জানালার কার্নিশে মাথা হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ সিনেম্যাট্রিক দৃশ্য। বাংলা হিন্দী তামিল তেলেগু মায় সিংহলিজ সহ সকল দক্ষিণ এশীয় চলচ্চিত্রে এমন দৃশ্যে সাঁনাইয়ে প্যাঁআআআআআ পুঁউউউউউউউউউউউউউ টাইপ করুন সুর বাজানো হয়। শুভর মনে এখন সাঁনাইবাবু বাঁশি বাজাচ্ছেন। তার মনটা একদম ভেঙ্গে গেছে। আহা কত স্বপ্ন ছিলো, আশা ছিলো। ঐশ্বরিয়ার মত কোন সুন্দর ললনা এসে তাকে বিয়ে করবে। তার জীবনটা ধন্য হয়ে যাবে। স্বপ্নেও কয়েকবার ঐশ্বরিয়া এসেছে তার ঘরে। সাদা ধবধবে বিছানায় সে শুয়ে আছে। ঘরময় শুভ্রতা। ঘরের দেয়াল থেকে শুরু ওয়াডরোব পর্যন্ত সব সাদা রঙ করা। ঐশ্বরিয়া ভেঁজা চুলে এসে তার পাশে বসেছে। আলতো করে তার ঘুম ভাঙিয়ে বলেছে, বাবু ওঠো, আমার অফিসে যাওয়ার সময় হয়েছে। নাস্তা বানিয়ে দাও।

আচ্ছা ঐশ্বরিয়া তো সিনেমায় অভিনয় করে। সে কেন অফিসে যাওয়ার কথা বলে। স্বপ্নে বলে জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠে না। নেক্সট টাইম স্বপ্ন দেখার সময় তাকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে। যে কলংক রটেছে তাতে কি ঐশ্বরিয়া আর শুভর স্বপ্নে আসবে। হায় ঐশ্বরিয়া, হায় ঐশ্বর্য্য।

শুভর বিয়ের জন্য বেশ চেষ্টা করা হচ্ছে। সুশীলা সেনের ইচ্ছে ছিলো একমুঠো টাকা পণ নিয়ে ছেলেকে বিয়ে দেবেন। পণ তো দূরের কথা এখন এই ছেলের বিয়ে হলেই হয়। ভালো ঘরের মেয়েরা এখন কেউ আর এই কলংকিত ছেলেকে বিয়ে করতে চাইছে না। শুভর বাবা বুঝতেই পারছেন এ আর এমন কি কলঙ্ক হয়েছে। এখনকার দিনের ছেলেরা কত্ত খারাপ সব কাজ করে। কেউ ছেলে হয়ে ছেলেদের সাথে প্রেম করে। কেউ কেউ আবার নিচু ঘরের মেয়েদের হাত ধরে পালিয়ে যায়। গরীব নিচু ঘরের মেয়েগুলো তো সব সময় শুভর মত ভোলাভালা গুল্টু গুল্টু ছেলেগুলোকে পটিয়ে বিয়ে করতে চায়। তারপর শ্বাশুড়ির সম্পত্তিতে ভাগ বসিয়ে হাতের উপর হাত রেখে শুয়ে শুয়ে খাবে।
কিন্তু ছেলেটার জন্য একটাও ভালো প্রস্তাব আসছে না। যা আসছে তাদের সাথে সমন্ধ করলে সমাজে মুখ দেখানো যায় না। শুভর মা তো টেনশানে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। আরে এটা কোন কথা হলো। টেনশানে, অভিমানে, রাগে দুঃখে, ক্ষোভে না খেয়ে থাকা, ঘরে দোর দিয়ে, জানালায় খিল দিয়ে কান্নাকাটি করা এগুলো সব পুরুষ মানুষের কাজ। এগুলো কি সুশীলাকে মানায় বলো।

অবশেষে সুশীলা সেন এবং গোবিন্দ গুপ্ত মিলে একটি চুক্তিতে সম্মত হয়েছেন। গোবিন্দের গুপ্তের ছোট কাকার ছেলেরা এখনও বাংলাদেশে রয়ে গেছেন। তার সাথে গোবিন্দ বাবুর মাঝে মাঝে পত্রালাপ হয়। সেই ভাই জানিয়েছিলো বাংলাদেশেও অনেক সুন্দর সুন্দর মেয়ে পাওয়া যায়। তো শুভকে বাংলাদেশ নিয়ে যাওয়া হোক। সেখানে কোন মেয়ে তাকে পছন্দ করলে ওখানেই বিয়ে দেওয়া হবে। অন্তত ওখানে তো আর কেউ ছেলের এই কলঙ্কের কথা জানতে পারবে না।

সেভাবেই সব আত্মীয় স্বজনকে জানানো হলো। কে কে সংগে যাবে তার সম্ভাব্য তালিকা তৈরী করা হলো। পন্ডিতকে ডেকে পাঠানো হলো শুভদিন ঠিক করতে যাতে শুভদিন দেখে যাত্রা শুরু করা যায়। পাশের বাসার এক কাকীমা অনেকটা ঠাট্টার সুরে বললেন, আরে এত দিন দেখার কি আছে, শুভ যে দিন যাত্রা করবে ঐ দিনই শুভদিন।

শুভ ভেবেছিলো সে সুইসাইডই করবে এই দৃশ্যে। সায়ানাইডের নীল রঙে রাঙিয়ে নেবে নিজের এই দ্রাবিড় বংশোদ্ভুত শরীরটাকে। কিন্তু কোন সিদ্ধান্তেই সে অটল থাকতে পারলো না। তার আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে এই বসুধার বুকে। বড় অর্থহীন এই বেঁচে থাকা। তবুও ইচ্ছে করছে। এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য মনে মনে তৈরী হচ্ছে শুভ। 

শুভবিবাহ-০৪: স্বপ্ন
তোরে রডে বসিয়ে বেল বাজাবো,
ও তুই হেলান দিবি আমার কোলে,
আয় সজনী চড়বি আমার হিরো শাইকেলে -কসমিক সেক্স, কোলকাতার বাংলা ম্যুভি।
টুংটাং শব্দে বেল বাজিয়ে একখানা রিকশা শুভদের গেটের সামনে এসে থামলো রিকশা থেকে নামলেন প্রণব মন্ডল পরিচিত সম্পর্কে দাদা হয় বয়সে বড় হওয়ার সুবাদে সময়ে অসময়ে তিনি শুভকে টিপস এন্ড ট্রিক্স দিয়ে থাকেন তবে এবারের পরিস্তিতি সম্পর্কে তার থলিতে বোধহয় তেমন কোন সঞ্চয় ছিলো না তাই তিনি লেট করে দেরী করে এসেছেন রাশভারী সুশীলা সেনকে বেশ ভয় করেন তিনি ঘরে ঢুকতেই শুশীলার সামনে পড়ে গেলেন নাকের উপর চশমা এঁটে তিনি খাতায় কোন কিছুর হিসেব কষছিলেন খাতা থেকে চোখ তুলে বললেন, কে? প্রণব নাকি? হাত দুখানা তুলে প্রণামের ভঙ্গিতে হাত জড়ো করে বললো, মাসীমা কেমন আছেন শরীর ভালো?
- আর শরীর রাজ্যের সমস্যা নিয়ে আর বাঁচিনা বাপু তুমি এসেছো বড্ড ভালো হয়েছে
- শুভ কই মাসিমা?
- যাবে আর কোথায়! দ্যাখো ঘরেই আছে ওকে একটু বুঝিয়ে বলো বাংলাদেশ আর এমনকি দূর! দিল্লী যেতে ট্রেনে চব্বিশ ঘন্টা লাগে সেখানে বাংলাদেশ যেতে মাত্র কয়ঘন্টার ব্যাপার আর কি সব চুক্তি টুক্তি হচ্ছে না, ওগুলো হলে তো সকাল বিকাল ঢাকা কোলকাতা লোকাল সার্ভিস চালু হবে শুঞ্চি ছেলে তো ভয়ে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে বাপ বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার আশায় সকাল সন্ধ্যা ধ্যান করে আর ছেলে হয়েছে উল্টো যাও একটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলো

শুভদের সাথে কে কে বাংলাদেশে যাবে তারই হিসেব করছিলেন শুশীলা কাকে কাকে নেওয়া যায় নেপু, পটকা, শিবু, দেবু রকি, অল্পন ধুর শুভর বাপের আক্কেল পছন্দ হলো না আজো খসড়া লিস্ট করে দিতে বলেছিলো শুশীলা খুড়তুতো, পিসতুতো, মাসতুতো শুভর যত প্রকার তুতো ভাই বোন আছে সবার নাম লিখে রেখেছে নাহ সংসার চালানোয় পুরুষ লোকের আজো কোন আক্কেল হলো না এতগুলো মানুষকে ওখানে নিয়ে যেতে গুচ্ছের টাকা লাগবে সে হিসেব কি রাখে সে যাদের কে শুশীলা নিয়ে যেতে চায় তারাই সব শোল মাছের মত পিছলে যাচ্ছে শুভ খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে ছিলো মিউজিক প্লেয়ারে গান বাজছে, সবাই গেছে বনে প্রণব ঘরে ঢুকে খাটের উপর বসে বললো, সবাই না গেলেও শুভ যে বনে যাচ্ছে সেখবর তো চাউর হয়ে গেছে তোর গ্রামের বাড়ি নাকি সুন্দরবনের ওদিকে ইশ আমার তো যেতে ইচ্ছে করছে আমাকে তোর সাথে নিবি?

শুভ বালিশ থেকে মাথা না তুলে বললো, তোমার যেতে ইচ্ছে করে তুমি যাও আমার কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই আমার এই ঘরই আমার স্বর্গ আর কিছু লাগবেনা আমার
- পাগল কোথাকার সব কিছু কি চাইলেই পাওয়া যায় অনেক চাওয়াই থাকে যা কখনোই পূর্ণ হয় না হয়তো চাওয়াটাই জীবনের মোক্ষ পেলাম না বলে হাল ছেড়ে দিলে হবে যা পাওয়া যাচ্ছে তা নিয়েই চেষ্টা করে দেখা উচিত রবি ঠাকুরের মত বলতে হবে, আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
- আজ কয়দিন তো পথের দিকেই চেয়ে ছিলাম আনন্দ বাবাজির দেখা তো পেলাম না আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না দাদা ইচ্ছে করছে র্যাট কিলার খেয়ে মরি আচ্ছা র্যাট কিলার দুই পাতা খেলে কি মরে যাবো? নাকি হাসপাতালে নিয়ে পাইপ ঢুকিয়ে ওয়াশ করাবে
- দুজ্ঞা দুজ্ঞা দুজ্ঞা কি সব বলিস মরবি কেন তুই বালাই ষাট তোর শত্রুরা মরুক শোন ভাই মরা অনেক সহজ বেঁচে থাকাটাই অনেক কঠিন তাইতো সবাই বাঁচতে চায় হাসপাতালের বেডে মৃতপ্রায় মানুষগুলোর মুখ দেখলে তুই বুঝতি বাঁচার আকূলতা কাকে বলে
-আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না বাঁচতে ইচ্ছে করছে না
এখনি বাঁচার ইচ্ছে চলে গেলে হবে তুই ভার্জিন অবস্থায় মরে গেলে দেবদূতেরা হায় শুভ হায় শুভ বলে রোনাজারি করবে মরার আগে অন্তত সতীচ্ছ্বদ পর্দা ফাঁটার আনন্দ নিয়ে মর
 বলতে বলতে দরজার পর্দা ঠেলে ঘরে ঢুকলো প্রান্তিক বয়সে শুভর থেকে অনেক ছোট কিন্তু পাকামিতে সোয়া সের লতায় পাতায় শুভদের যেন কোন দিক থেকে আত্মীয় হয় শুভর বড় খুড়ীমার মেজ পিসির সেজ বৌদির ছোট ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ির দিকের কেউ প্রান্তিক বয়সে ছোট হলে কি হবে জ্যাঠামিতে সে এপাড়ার শুধু কেন ওর নিজের পাড়া খড়গপুরের শিরোকূলমণি সে। প্রণব প্রান্তিককে খুব একটা পছন্দ করেনা। ছেলেটার জ্যাঠামি একটু বেশী। গায়ে পড়ে কথা বলে। সীমা পরিসীমা বোধ নেই। প্রণবের বেজার মুখ দেখে খোঁচা মেরে বললো।
-      কি প্রণবদা, আজকেও বৌদির হাতে মার খেয়ে এখানে এসে পালিয়েছো।
প্রণব গোমড়ামুখেই বললো, আমার মত স্ত্রীব্রত পুরুষেরা কখনো বউয়ের হাতে মার খায় না। ওসব মার তোর কপালে জুটবেই। কি সব শুনতে পাই আজকাল।
-      কি শুনেছো? ওসব কান কথায় কান না পাতলেই পারো তাতে কান পাতলা হবে।
শুভ উঠে বলে, আমিও শুনলাম প্রান্তিক। তুই নাকি চরিত্রহীন। ও পাড়ার দেবরাজ সেদিন বাজারের পথে দেখা হলে বলছিলো। পাড়ায় যত বদমাইশ মেয়ে আছে তাদের সাথেই তোর সখ্যতা। সবাই নাকি তোকে ভোগ করেছে।

প্রান্তিক গর্বের সাথে বলে, কেন তোর হিংসে হচ্ছে বুঝি। বুঝলাম না আমি এই যে এত এত মেয়ের সাথে পার্কে যাই, হোটেলে যাই, কই আমার নামে তো কেউ কিছু রটানোর সাহস পায় না। আর তোর কি না কি হলো। তাতেই তোর বিয়ে দিতে বাংলাদেশে নিয়ে যাচ্ছে।

প্রণব প্রান্তিকের ঘনকথার মাঝে কথা বলার চান্স পাচ্ছিলো। একটু ফাঁকা পেতেই সে টুক করে জিভ বাড়ালো, শুধু মেয়েদের সাথে হলে তো হয়েছিলো। শুনলাম নাকি ছেলেদের সাথেও। রাম রাম রাম।
ওহে ও প্রণব দা, তুমি হলে পর্দানশীন পুরুষ। জীবনকে চেটেপুটে উপভোগ করার মজা তুমি কি বুঝবে।

-      না বাবা আমার ওসব বুঝে কাজ নেই। আমি এভাবেই ভালো আছি। আমার অত লুটে পুটে কাজ নেই।
প্রান্তিক টুপ করে প্রণবের চিবুকে চুমু খেলো। প্রণব কাজলি মুরগির মত লাফ দিয়ে উঠলো। হাতের উলটো পিঠ দিয়ে গাল মুছতে মুছতে বললো, ছ্যা ছ্যা ছ্যা। কি সব ম্লেচ্ছদেশীয় কাজ। রি অবেলায় বাড়ি ফিরে আমাকে আবার নাইতে হবে।

সত্যি বেলা গড়িয়ে গেছে। তিনজনে গল্প করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। শুভ বেশ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। এটা একটা চমৎকার ব্যাপার। যাদের সংগ ভালো লাগে তাদের সাথে কিছুক্ষণ বসে কথা বললে মন ভালো হয়ে যায়। প্রণব উঠি উঠি করেও আরো কিছুক্ষণ বসে রইলো। হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে প্রান্তিক লাফিয়ে উঠলো, মাইরি বলছি, আমি আর বসতে পারবো না। আমার কাজ আছে।

প্রনব বললো, কাজ কি সে আর আমাদের বুঝতে বাকী নেই। এইডস টেইডস হলো কিনা একটু চেক করিয়ো বাপু।

-      তুমিও করিয়ো। এই যে তোমাকে চুমু খেলাম। তোমার শরীরেও এইডস লাগিয়ে দিয়ে গেলাম। হ্যারে শুভ। বাংলাদেশে তোর বিয়ে হচ্ছে। আমার কিন্তু বেশ লাগছে। হোক বাংলাদেশ, তবুও বিদেশ তো। আমার আর এখানে ভালো লাগে না। ইশ আমিও তোর মত দূরে কোথাও চলে যেতে পারতামবাড়ি ঘর সব সব্বাইকে ছেড়ে, অনেক অনেক দূরে, যেখানে কেউ আমাকে চিনবে না। যেখানে আমি আমার মত করে থাকতে পারবো, বাঁচতে পারবো নিজের স্বপ্ন নিয়ে। ঐ বাংলাদেশেরই কে একজন বলেছেন, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়।

 
শুভবিবাহ-০৫: যাত্রা
কে যায় রে,
ভাটির গাও বাইয়া,
আমার ভাইজানরে কইয়ো নাইর নিয়ে যাইবার... পল্লীগীতি

মধ্যজানুয়ারীর ভোরবেলা শুশীলা সেনের হাঁকডাকে শুভর ঘুম ভেঙে গেলো। এত আর্লি বিছানাকে বিদায় জানাতে কার জানে চায়। কিন্তু উপায় নেই। আজকে রওনা করার দিন। জার্নি টু বাংলাদেশ। শুভ অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁত ব্রাশ করে নিলো। গোছগাছ করে বেরোনোর আগেই বারদুয়েক তাড়া দিয়ে গেলেন শুশীলা। গোবিন্দ গুপ্তও একবার এসে বলে গেলেন নিচে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে।

পঁচিশজনের লিস্ট এখন সাড়ে পাঁচে নেমে এসেছে। শুভরা তিনজন সংগে যাচ্ছে ছোটকা আর বড় মামা বাবু। সাড়ের পিঠে ভর করেছে অল্পন বাবু। এই পাঁচ সকালে সেও ফুলবাবুটি সেজে এসেছে। তার এক বায়না তাকে নিতেই হবে। কোন কথা শোনেনা। অনেক করে বোঝানো হলো। কিছুই বুঝতে চায় না। সে যাবেই যাবে। এতো পুরী কি ধানগড় না যে কাকু কোলে করে নিয়ে যাও বললেই কাঁধে তুলে নেয়া। অল্পনকে পাসপোর্ট ভিসা ইত্যকার জিনিস দিয়েও বোঝানো হলো। সে ফোঁস ফোঁস করে কাঁদতে লাগলো। শেষমেষ রেগে কাঁই হয়ে শুশীলা সেন অল্পনকে দিলেন এক ঝাঁড়ি। অল্পন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। কাঁদবে নাকি কাঁদবে না বুঝতে পারলো না। শুভ তার পুরোনো আট পিক্সেলের ক্যামেরাটা দিয়ে দিলো অল্পনকে। অল্পন কান্না ভূলে তখনি ফটোগ্রাফী শুরু করে দিলো।

ট্যাক্সি এসে থামলো সল্টলেক সিটির সেক্টর ২ এ, করুনাময়ী ইন্টারন্যাশনাল বাস টার্মিনাল। সাতচল্লিশের আগে পূর্ববংগ আরর পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে ট্রেন যোগাযোগ চালু ছিলো। কলকাতা থেকে ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, গোয়ালন্দ পর্যন্ত ট্রেন চলতো প্রতিদিন। ভারত পাকিস্তান পৃথক হয়ে যাওয়ার পরেও দীর্ঘদিন তিনটি ট্রেন চালু ছিলো। পূর্ববংগ মেইল, পূর্ববংগ এক্সপ্রেস এবং বরিশাল এক্সপ্রেস। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তানের সম্পর্কে অবনতি ঘটলে ট্রেন তিনটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এর তেতাল্লিশ বছর পরে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে মৈত্রী ট্রেন চালু হয়। এর পরে মৈত্রী বাস। ঢাকা-কোলকাতা-ঢাকা। সম্প্রতি খুলনা-কোলকাতা বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। কুঁয়াশার চাদরে মুড়ে আছে পুরো বাস স্টেশান। এখানে ওখানে মানুষের জটলা। ট্যাক্সি থেকে নেমে ছোটকা মালপত্তর গুলো টানাটানি শুরু করে দিলেন। ছোটকার বয়স তেত্রিশ। দেখতে সিনেমার নায়কদের মত। একবার এক সিনেমায় তিনি ডাক পেয়েছিলেন। কিন্তু হালের নায়িকাপ্রধান সিনেমা অভিনয় করার আগ্রহ পাননি। বলেছিলেন যদি কোন পরিচালিকা নায়ক প্রধান সিনেমা বানাতে আগ্রহী হন তবে তিনি ভেবে দেখবেন। ছোটকার গাটস দেখে শুভ বিস্ময়ে ঢেকুর তুলেছিলো। যেখানে সবাই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য হামলে পড়ে। নায়িকাদের কুপ্রস্তাবে রাজী নয়। পরিচালিকাদের হাতের পুতুল হয়ে যায় সেখানে ছোটকা এত সাহস কিভাবে সঞ্চয় করলেন ভাবতেই শুভর হাতের পশম খাড়া হয়ে যায়।

মামাবাবু গোবিন্দগুপ্তের সাথে বাস কাউন্টারে গেলেন। শুশীলা সেন ফোনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেলেন। কার সাথে কথা বলছেন বোঝা গেলো, শুধু এটুকু শুনতে পেলোনা, “আর বলো না, আই এম ফিলিং রিলিভড নাউ। গত একটি মাস যা ধকল গেলো না”। কোলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালীদের মধ্যে কথায় কথায় ইংরেজী প্রীতি এখনো বহাল আছে স্বগৌরবে। শুভ ফাঁকা প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ তার চোখ পড়লো টি স্টলের দিকে। তারই বয়সী একটা ছেলে মাটির ভাঁড়ে করে চা খাচ্ছিলো। ছোট মাটির কাপটা পাশে নামিয়ে রেখে ক্যামেরা তাক করে শুভর একটা ছবি তুললো। অলক্ষ্যেই হয়তো তুলতে চেয়েছিলো। কিন্তু চোখাচোখি হয়ে যাওয়াতে একটা বোকা বোকা হাসি দিলো।

শুভ ভাবতে লাগলো ছেলেটা তার ছবি কেন তুললো! কি করবে সে ছবি দিয়ে। লেগবুকে আবার পোস্ট ফোস্ট করবে নাতো! আবার তাকালো ছেলেটার দিকে। যেন কিচ্ছু হয়নি এমন ভাব নিয়ে ছেলেটা চা খাচ্ছে। মুখভরা ইঞ্চি খানের লম্বা দাঁড়ি। এটা কি স্টাইল নাকি সপ্তাহ খানেক শেভ না করার জন্য এমন হয়েছে। শ্যামাংগী চেহারা, কৃশকায় বলা চলে। চোখে রিমলেস চশমা। ডিএসএলআর ক্যামেরাটা গলায় ঝুলিয়ে রেখেছে।

ডাক শুনেই সে পেছন ফিরলো। ছোটকা ডাকছেন। “শুভ ঠান্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে কি করছিস। ওয়েটিং রুমে চলে আয়”।

-   বাস কখন ছাড়বে ছোটকা?
-    সাড়ে সাতটায়। এখনো পঁয়ত্রিশ মিনিট বাকি। আয় ভেতরে এসে বোস।
শুভ ভেতরে চলে গেলো। সে পেছনে ফিরলে দেখতে পেতো ছেলেটা টুক করে তার পশ্চাৎদেশের ছবি তুলছে। শুভ অপেক্ষা করতে থাক ইত্যবসরে আমি তোমাদের এই ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফারের পরিচয় দিয়ে দেই। ছেলেটার নাম সায়ন্তন। সায়ন্তন ভট্টাচার্য। অবিবাহিত। বিবাহ করবে কিনা তা ভবিষ্যত দেবতাই বলে দেবেন। তার প্যাশন হচ্ছে ফটোগ্রাফি। লেগবুকে যদি তার টাইমলাইনে ঢোকো তাহলে দেখতে পাবে যে বাস স্টেশানে হিসুরত পুরুষ, স্নানের ঘাটে অর্ধউলংগ পুরুষের ছবিতে ভরে আছে।

বাস টাইমলি ছাড়লো। বনগাঁ হয়ে বেনাপোল দিয়ে বাস বাংলাদেশে ঢুকবে। বাস চলছে। একটু একটু করে সল্টলেক সিটি পেছনে সরে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো সল্টলেক সিটি হারিয়ে গেলো। ক্রমে ক্রমে চেনা কোলকাতা ছাড়িয়ে ফাঁকা রোড ধরে বাস ছুটছে। দোতলার দক্ষিণ দিকের ঘরটাতে ফিরে যাওয়ার জন্য শুভর মন আঁকুপাকু করছে। বাসে মৃদু শব্দে গান বাজছে, কে যায় রে, ভাটির গাং বাইয়া...

শুভবিবাহ-০৬: পিতৃভূমে
ঐ দেখা যায় তালগাছ,
ঐ আমাদের গা,
ঐখানেতে বাস করে কানাবগির ছা...

সকালের কুয়াশা ছাঁপিয়ে সোনালী রোদ্দুর ছুটে আসছে। বাস বনগাঁ পেরিয়ে বাংলাদেশের বর্ডারে চলে এসেছে। শুভ ঘুমিয়ে পড়েছে। ছোটকার ধাক্কায় ধড়ফড়িয়ে উঠলো। চোখ কচলে ছোটকা কে জিজ্ঞেস করলো, “এসে গেছি?” ছোটকা শুভর চুল নেড়ে দিয়ে বললো, “ধ্যুর বোকা। এখনো অনেক পথ বাকি। সবে সীমান্তে এলাম। এখন সিকিউরিটি চেক। নাম”।

কুলির মাথায় মালছামানা তুলে দিয়ে সবাই সিকিউরিটি পাসে গিয়ে উপস্থিত হলো। সিকিউরিটির চেহারা দেখে মনে হলো সে মহা বিরক্ত, দিন দুনিয়া সব কিছুর উপর বিরক্ত এরকম একটা অভিব্যক্তি নিয়ে বসে আছে। প্রশ্ন করে একেকজনকে নাজেহাল করে দিচ্ছে। এক প্রশ্ন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দশবার করে। কেন যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি, উদ্দেশ্য কি, কতদিন থাকবো ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্নে জেরবার করে তুললো। কোন প্রশ্নের উত্তর তার মনোঃপুত হয় না যেন। পুরো বাসের সবাইকে জেরা করতে ঘন্টা দুয়েক সময় লেগে গেলো। এই সময়ে তাদেরকে ছোট একটা ঘরে গাদাগাদি করে বসিয়ে রাখলো। শীতের দিনেও ঘরটা গুমোট হয়ে উঠলো এতগুলো মানুষের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে। আরো কয়েকটা বাস ইতোমধ্যে চলে এসেছে। শুভ বিরক্ত বোধ করছে। ইচ্ছে করছে বাইরে গিয়ে প্লাটফর্মে গিয়ে একটু হাঁটাহাটি করে আসি। ছোটকা একবার যেতে চেয়েছিলেন। অনুমতি পেলেন না। শুভর মেজাজ খারাপ হলো। সীমান্তে যে এত এত চোরাচালান হয় তার টিকিটিও ছোয়ার সাধ্য নেই বাবুর আর ম্যাঙ্গোপিউপলের উপর বাহাদুরি ফলানো।

অবশেষে চেকিং শেষ হলে ভারতের অংশের গেট খুলে দেয়া হলো। সবাই পায়ে হেঁটে নো ম্যান্স ল্যান্ডে পা বাড়ালো। শুভ’র বেশ ভালো লাগছে খোলা বাতাসে আসতে পেরে। বাংলাদেশ ভারত যেখানেই যাওনা কেন সব স্থানের মালিক আছে। এটা আমার জায়গা, ওটা অমুকের জায়গা। যে জায়গার কোন ব্যক্তি মালিক নেই সে জায়গা কোন গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠানের অথবা সরকারের। লাওয়ারিশ জায়গা নেই। অথচ এই জায়গাটুকুর কোন মালিক নেই। একদম যে নেই তা বলা যাবে না। ইশ্বরের অদৃশ্য সাইনবোর্ড বসানো আছে কোন কোণে, ‘‘‘এই স্থানের মালিক সৃষ্টি সুত্রে জনাব ইশ্বর গং, ঠিকানাঃ স্বর্গ, মহাজগৎ’’’। মাল পত্র নিয়ে কুলিরা এগিয়ে যাচ্ছে। এখানে সব কুলির নম্বর দেয়া আছে। সবার ধারণা সীমান্ত হলো অতি খারাপ একটা জায়গা। চোরাচালানি, চোর ছ্যাচড়ে ভরা। কিন্তু শুভর মনে হলো সীমান্তের এই কুলিরা অসম্ভব রকম সৎ এবং ভালো। বাংলাদেশের গেটের কাছে এসে বাংলাদেশী কুলিদের মাল বুঝিয়ে দিয়ে ভারতের কুলিরা ফিরে গেলো। একটু একটু করে খুলে যাচ্ছে বাংলাদেশের গেট। প্রিয় পিতৃভূমির গেট। যে দরজা একদা বন্ধ হয়ে গেছিলো স্বার্থলোভী কিছু মানুষের কূটচালে।  গোবিন্দ গুপ্ত ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। আহ এই সেই মাটি। মায়ের মত পবিত্র। যার ধূলিস্পর্শে কেটেছে তার শৈশব কৈশোর। নিচু হয়ে পিচঢালা পথকে স্পর্শ করলেন হাতের আঙুলে। যেন খুব চেনা স্পর্শ পেলেন। আঙুলের ডগায় মাখা ধুলো নিয়ে কপালে ছোঁয়ালেন। শুভও বাবাকে অনুসরণ করলো। হাসি কান্না সংক্রামক। কঠিন শুশীলা সেনকেও দেখা গেলো আচলে চোখ মুছতে।

বাংলাদেশ পাশে একই ফর্মালিটি। ছোট ঘরে বসে অপেক্ষা। প্রশ্ন উত্তর চলছেই। অফিসারকে খুব বেশী রুক্ষ মনে হলো না শুভর কাছে। এই জায়গাটার নাম বেনাপোল। কাঁটাতারের ওপাশের সাথে খুব বেশী আলাদা নয়। একই রকম গাছপালা, মানুষজন। অথচ দুই দেশ, সব কিছুকে আলাদা করার আপ্রাণ চেষ্টা। পারলে তো আকাশেও কাঁটাতারের বেড়া টাঙিয়ে দেয়।

আবার বাস ছুটছে। যশোর পেরিয়ে গেলো। বাবার কাছে শুভ শুনেছে বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের সাথে মুক্তির যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তখন সর্বপ্রথম এই যশোর এলাকা পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করতে সমর্থ হয়। শীতকালের বেলা দুরন্ত হরিনীর মত ছুটে চলে। সূর্য্যমামাও তার পিছ পিছ ছুটছে। তারা যখন খুলনায় এসে পৌছালো তখন সুর্যিমামা অফিসের কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

খুলনার সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালে তাদেরকে নামিয়ে দেয়া হলো। বাসস্ট্যান্ডে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন গোবিন্দবাবুর খুড়তুতো ভাই। শুভ তার এই কাকুকে চেনেন। অনেক আগে তাদের কলকাতার বাড়িতে গিয়েছিলেন। তখন নাকি কলকাতা যাওয়া এত সোজা ছিলো না। দীর্ঘদিন পরে দুই ভাই আলিংগন করলো পরষ্পরকে। চোখের সফটওয়্যার আরো কিছু অশ্রুপাত ঘটানোর কমান্ড দিলো। মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা করা ছিলো। গন্তব্য আরো ত্রিশ কিলো দক্ষিণে। ওখানেই কাকাবাবুর বাড়ি। পথিমধ্যে দুটো নদী পড়লো। ছোট নদী। একটার উপর ব্রিজ আছে অন্যটি ফেরিতে করে পার হতে হলো। যখন তারা বাড়িতে পৌঁছলো তখন শুভর ঘড়িতে সাড়ে সাতটা বাজে। শুভ হাত ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে দেখে মামাবাবু বললেন, ঘড়ির কাঁটা আধা ঘন্টা এগিয়ে দাও শুভ। আমরা এখন বাংলাদেশের টাইম জোনে আছি। এরা আমাদের থেকে আধাঘন্টা এগিয়ে আছে।

শুভর মনে পড়ে গেলো যে তাদের যখন সাড়ে সাতটা বাজবে তখন বাংলাদেশে আটটা বাজে। এত কাছাকাছি অবস্থিত কোলকাতা খুলনা তাহলে সময়ের এত পার্থক্য হয় কিভাবে? ছোটকাকে জিজ্ঞেস করতে বললো যে বাংলাদেশের উপর দিয়ে নব্বুই ডিগ্রি দ্রাঘিমা অতিক্রম করেছে। সেটার উপরে ভিত্তি করে এদের টাইম জোন নির্ধারণ করা হয়েছে। দুইদেশ না হলে আমরাও হয়তো এই সময় অঞ্চলে পড়তাম। কিন্তু যেহেতু আলাদা দেশ সেহেতু আমাদের ওদিকে কাছাকাছি এলাহাবাদের টাইমজোনের সাথে আমাদের যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।

বাড়ির মধ্যে ঢোকার সাথে সাথে যেন উৎসব মুখর পরিবেশ তৈরী হয়ে এলো। সিরিয়ালের চরিত্রের মত সবাই একযোগে স্বাগত স্বাগত বললো না বটে কিন্তু সবার চোখে মুখে নির্ভেজাল হাসি। পরিচিতি পর্ব সারতে সারতে রাত আরো কিছুটা বেড়ে গেলো। আশপাশ থেকে প্রতিবেশীরাও আসছে দেখা করতে। কলকাতার নগর জীবনে এরকম আন্তরিকতা শুভ অনেক দিন দেখে নাইকাকাবাবু সবাইকে তাড়া লাগালেন। “আরে আরে সব বসে রইলে কেন! এতটা পথ আসলো সবাই। জল কই। সবাই চোখে মুখে জল দিয়ে একটু জলপানি খাক। বাবা শুভ চান করবা তো? কই তিলক কই গেলি? এদিকে আয়। ছেলেটা যা লাজুক না। আয় আয় এদিকে আয়”।

কাকাবাবু এক নিঃস্বাসে অনেকগুলো কথা বলে ফেললেনদরজা ঠেলে শ্যামল বরণ স্বাস্থ্যবান একটা ছেলে এগিয়ে এলো। চোখে উপর গোল কাঁচের চশমা। বেশ নাঁটু গোপালটি চেহারা। “তিলক এই হচ্ছে তোমার এক দাদা। আজ থেকে তোমার ঘরে থাকবে। যাও দাদাকে চানের ব্যবস্থা করে দাও”।

শুভ ভেবেছিলো ছেলেটা বোকাসোকা টাইপের হবে। কিন্তু ভূল ভাঙতে সেকেন্ড লাগলো না। “কি দাদা তুমি কলকাতার ছেলে এত চুপচাপ কেন? শুনেছি কলকাতার ছেলেরা এখন অনেক আধুনিক। আসো আসো”। হাত ধরে টান দিলো। শুভ তিলকের সাথে উঠে গেলো। তিলক চিৎকার করে বললো, মা, শুভ দা চান করবে। জল গরম করো।
শুভ বাঁধা দিয়ে বললো, আরে না না জল গরম করতে হবে না।
তিলক বললো, কি যে বলো না দাদা। এখানে তুমি কলকাতার বাড়ির মত শাওয়ার পাবে না। এই রাতদুপুরে পুকুরে চান করতে নেমে আবার নিউমোনিয়া বাঁধিয়ে বসবে তখন সবাই মিলে আমাকে কানের উপর দিবে।

পাশ্ববর্তী কোন প্রতিবেশীর ঘর থেকে শব্দ ভেসে এলো, বলো বাবা তার পরে কি?
কচি কন্ঠের আবৃত্তি শোনা গেলো, ও বগি তুই খাস কি?
পান্তা ভাত চাস কি?
পান্তা আমি খাইনা,
পুঁটি মাছ পাইনা,
একটা যদি পাই
অমনি ধরে হাপুস হুপুস খাই।

পূনরায় বয়স্ক জনের কন্ঠ শোনা গেলো, কানাবগি কিভাবে পুঁটি মাছ খায় বলো তো। হয়তো সে কোন অংগভঙ্গি করেছিলো। সুমিষ্ট কন্ঠে বাচ্চাটি খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো একই সাথে।

শুভবিবাহ-০৭: শুভ্র সকাল
আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে...
তিলকের কন্ঠে রবীন্দ্রসংগীত ভালই খোলে। বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গনে আয়োজিত প্রতিযোগীতায় সে একটা না একটা মেডেল জিতবেই। গুনগুন করতে করতে তিলক শুভকে খোঁচা দিলো। “দাদা ওঠো। অনেক বেলা হয়ে গেছে। আর কত ঘুমুবে! ওঠো”।

শুভ আচম্বিতে তিলকের নাম মনে করতে পারলো না। মাঝে মাঝে এরকম হয়। স্বল্প পরিচিত লোকদের নাম মনে পড়েও পড়ে না। সে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, কত বেলা হয়েছে বাবু?
তিলক টেবিলের উপর কিছু একটা রেখে বলে, নটা বাজে। এই পেস্ট রেখে গেলাম। উঠে দাঁত ব্রাশ করে নাও। ব্রাশ আছে তোমার কাছে?
শুভ সায় দিলো। “হুম আছে”। অদূরে কেউ তিলক বলে ডাক দিলো। তিলক গলা চড়িয়ে জবাব দিলো, আসি।

তারপর তার পড়ার টেবিলের উপর কি একটা নাড়াচাড়া করতে করতে বিড়বিড় করতে লাগলো, সবার খালি তিলক আর তিলক। তিলক ছাড়া যেন এক তিল কেউ চলতে পারে না। কোথাও বসে দুদন্ড হাড়ে বাতাস লাগানোর জো নেই।

পিচ্চি ছেলেটার পাকাপাকা কথায় শুভর বেশ হাসি পেলো। শুভ জিজ্ঞেস করলো, বাবা কোথায়?
-   ও ঘরের বারান্দায় বসে প্রিয় গুপ্তের সাথে কথা বলছেন।
-   প্রিয় গুপ্ত কে?
-   ওব্বা! প্রিয় গুপ্তকে চেন না?
-   ঠিক মনে পড়ছে না? কে তিনি?
-   আরে প্রিয়ব্রত গুপ্ত। আমার বাবা। তোমার খুড়ো।
-   অবাক করলে। বাবাকে তুমি নাম ধরে ডাকো।
-   নাম তো রাখা হয় নাম ধরে ডাকার জন্য। একজন থেকে অন্যজনকে পৃথক করার জন্য। যাদের নাম জানা নেই তাদের আমরা বলি ঐ লম্বুটা কি বাঁটুল ছেলেটা বলে। সো যার নাম আছে তার নাম ধরে ডাকাই উচিত।

শুভ প্রতুত্তোরে বলার মত কথা পেলো না। তিলক ফিচেল একটা হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেলো। দরজা খোলা। দরজার বাইরে বারান্দা পেরোলেই উঠোন। উঠোনে দুধ সাদা কুয়াশা। সকাল নটায় এত কুয়াশা! আজ মনে হয় আর রোদ উঠবে না। কাল এত টায়ার্ড ছিলো যে কোন দিকে খেয়াল করার সুযোগ পায়নি শুভ। রাতে কি খেয়েছিলো সেটাই এখন মনে নেই। ধারে কাছে কোথাও শিউলি ফুলের গাছ আছে বলে মনে হচ্ছে। শিউলি ফুলের মিষ্টি গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। দরজা দিয়ে কুয়াশা ভেজা আলো এসে পড়েছে ঘরের মধ্যে। শুভ শুয়ে শুয়ে চারপাশ তাকিয়ে দেখলো, এককোণে পুরনো আমলের ডিজাইনের একটা আলমারি। তারপাশে আলনার উপর তিলকের কাপড় এলোমেলো করে রাখা। অন্যদিকে টেবিলের উপর তিলকের বই খাতা। কোন ক্লাসে পড়ে ছেলেটা? জিজ্ঞেস করা হয়নি! টেবিলের লাগোয়া দেয়ালে দেবী স্বরসতীর ছবি। শ্বেতশুভ্র রাজহংসীর উপর বীনা হাতে দেবী হাসোজ্জ্বল মুখে বসে আসছেন। পানিতে কিছু পদ্ম ফুটে আছে পায়ের কাছে। শুভর বাড়িতেও দেবীর ছবি ছিলো। তবে ঐ ছবিতে দেবী পদ্মের উপর বসে আছেন এবং পানিতে রাজহাঁস সাঁতার কাটছে। পরীক্ষার আগে দেবীর কাছে করা বিভিন্ন প্রতীজ্ঞার কথা মনে পড়ে যাওয়ায় শুভ আপন মনেই হেঁসে উঠলো।

খানিকক্ষণ আড়মোড়া ভেঙে সে উঠে বসলো। কি ঠান্ডারে বাবা। টি শার্ট আর শর্ট পরেই শুয়েছিলো। হাত বাড়িয়ে খাটের হাতার উপর থেকে শোয়েটার নিয়ে পরলো। হাওয়াই চপ্পলে পা গলিয়ে সে বাইরে এলো। সিড়ির কাছেই বেশ বড় একটা শিউলি গাছ। শিউলি তলা ফুলে ফুলে সাদা হয়ে আছে। ওখানে একটা মা মুরগী বসে কুরকুর করছে। তার পাখার নিচে বসে বাচ্চারা মাঝে মাঝে মাথা বের করে উঁকি দিচ্ছে। দুই একটা বাচ্চা বেশ দুষ্টু। মায়ের পাখার নিচ থেকে বেরিয়ে ছুটে যাচ্ছে। মুরগীটা তখন কুরকুর করে ডাক দিলে বাচ্চাটা আবার মায়ের ডানার নিচে ফিরে যাচ্ছে।

শুভ উঠেছো? ডানদিকের ঘর থেকে প্রশ্নটা ভেসে এলো। শুভ সেদিকে তাকাতেই কাকীমাকে দেখতে পেলো। রান্নাঘরে বসে তিনি কাঠের চুলায় রান্না করছেন। শুভ সেদিকে এগিয়ে গেলো। পাশে বসে একটা মেয়ে একমনে নারিকেল কুরিয়ে যাচ্ছে। কাকীমা মেয়েটিকে বললেন, “মোক্ষ, যা তো জগে করে দাদাকে এক জগ গরম জল দে”। এরপর শুভর দিকে ফিরে বললেন, নাও বাবা মুখ ধুয়ে নাও। খেঁজুরের পায়েস রান্না করছি। তোমাদের ওখানে খেঁজুরের রস পাওয়া যায়?
-   খেঁজুরের রস পাওয়া যায়। কিন্তু সেগুলো খেঁজুর গাছে হয় কিনা সন্দেহ আছে।
-   সে আবার কেমন কথা! তবে খেঁজুরের রস কোন গাছে হয়?
-   জলে গুড় টুড় মিশিয়ে বানায় নাকি শুনেছি। আমি ঠিক জানিনা।
-   মা কোথায়?
-   দিদি তো তোমাদের বাবাদের সাথেই কথা বলছিলেন। বিকেলে ছোঁয়া বু আসবে। তার ব্যাপারে কথা হচ্ছে।
-   ছোঁয়া বু কে?
-   ছোঁয়া বু হচ্ছে এই এলাকার সুবিখ্যাত ঘটক। হাজারের উপর বিয়ে দিয়েছেন তিনি। বিকেলেই দেখতে পাবে।
-   বু? মুসলিম?
-   হ্যাঁ। মুসলমান।
-   উনি কি সব ধর্মের বিয়ের কারবার করেন।
-   আসলে ছোঁয়া বু জাতে মুসলমান। কিন্তু ঘটকালি ওনার পেশা। আর পেশার কোন ধর্ম নেই। এটা আমার কথা না। ছোঁয়া বুর কথা। সেজন্যই তো এলাকার সবার কাছেই উনি বু নামে পরিচিত। সকল ধর্মের বিয়ের কারবারে মেতে থাকেন। এরকমটি তুমি ভূভারতে আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাবে না।

কাকীমার কথায় শুভর বেশ হাসি পেলো। বাংলাদেশের কারো মুখে ভূভারত কথাটা ঠিক কেমন যেন শোনালো। সে হাসি গোপন করে বললো, শুনি যে ঘটকদের বিয়ে হয় না। তো এই ছোঁয়া বুর কি বিয়ে টিয়ে হয়েছে। নাকি সে নিজে শুধু বিয়ে দিয়ে বেড়ায়।
-   কে বলেছে ঘটকের বিয়ে হয় না। আমার জানা সব ঘটকের বিয়ে হয়েছে। ছোঁয়া বুরও বিয়ে হয়েছে। তবে জামাইডা কোন কামের না। ভাদাইম্যা। গান বাজনা নিয়া সারাদিন মেতে থাকে। একটা মেয়েও আছে।
-   কাকীমা তিলক কই?
-   এই দেখো। তিলককে সেই কখন দোকানে পাঠিয়েছি। এখনো ফেরার নাম নেই। ছেলেটাকে নিয়ে যে কি করি।
-   কেন কেন তিলকের আবার কি হলো? কি করেছে সে? বলতে বলতে তিলক এসে হাজির। সে কাগজে মোড়া কিছু পুঁটলি ঠপ করে রান্নাঘরে মায়ের সামনে ছুড়ে দিলো, এই ন্যাও গরম মসলা। কালোজিরে কোন দোকানে পাইনি। সব দোকানে খুঁজে দেখেছি কিন্তু। আবার বইলো না যে এক দোকানে পাইনি বলে চলে আসছি। নাও দাদা মুখ ধুয়ে নাও।

কাকিমা কালিজিরা ছাড়া কিভাবে হবে বলে মোক্ষদাকে পাঠিয়ে পাশের কোন বাড়িতে। শুভ দাঁত ব্রাশ করতে করতে উঠোনে পায়চারি করতে লাগলো। তিলক বললো, দাদা চলো রাস্তা থেকে হেঁটে আসি।

শুভবিবাহঃ -০৮ – প্রজাপতেঃ নমোঃ
-   সত্য কাজে কেউ নাই রাজী
-   সব দেখি তা না না না না
-   জাত গেলো জাত গেলো বলে
-   একি আজব কারখানা।।
-    
-   আসবার কালে কি জাত ছিলে
-   এসে তুমি কি জাত নিলে
-   কি জাত হবে যাবার কালে
-   সে কথা ভেবে বলনা।।  -লালন সাঁইজি
“দাদা ওঠো।এই ঠান্ডা জলে আর কত দাপাদাপি করবা”। তিলক তার স্বভাবস্বরূপ উচ্চগ্রামে গলার ভয়েস চড়িয়ে বাক্যটি শুভর পানে ডেলিভারি দিলো। শুভ তিলকের কথার কোন ফিডব্যাক না দিয়ে আপন মনে সাঁতার কাঁটতে লাগলো। শীতের দিনে পুকুরের জলও কেমন যেন মনমরা হয়ে থাকে। অনেকটা সদ্য মা হওয়া কুকুরীর মত। কাছে গেলেই কামড়ে দেবো টাইপ এটিচ্যুড নিয়ে বসে থাকে। জলও তেমন। শীতের দিনে কেউ তার শরীর স্পর্শ করলে অদৃশ্য দাঁত দিয়ে অবিরত দংশন করতে থাকে।

তিলকদের বাড়িটা বেশ বড়। অনেকটা পুরোনো দিনের সব বাড়ি ঘরের মত। এই যেসব বাড়ি ঘরের কথা শরৎ বিভূতিরা তাদের লেখায় লিখে গেছেন আর কি। বাড়ির পেছনে আম কাঠের বাগান। একটা গাছ দেখিয়ে তিলক বললো গাছটার বয়স নাকি একশো দেড়শো বছর। গাছটা যে অনেক পুরোনো সে বিষয়ে শুভর কোন কনফিউশন নেই কিন্তু দেড়শো বছর! মানতে কষ্ট হয়। তিলককে বলতে বললো, কেন তোমাকে কি গাছের বার্থ সার্টিফিকেট দেখাতে হবে?
-   হ্যাঁ দেখাও।
ছেলেটার অন্যরকম কথাবার্তায় শুভ মজা পাওয়া শুরু করেছে। সে তিলকের সাথে একই এংগেলে কথা বলার চেষ্টা করছে। তিলকও কম যায় না।
-   ওকে দেখাবো। আগে চান করে নাও। এই গাছের বার্থ সার্টিফিকেট স্বয়ং লাট সাহেব নিজে হাতে দিয়েছিলেন। বাবার ঘরের আলমারিতে তোলা আছে। সাহেবি ইংরেজীতে লেখা তো। পড়তে পারলে হয়।

ঘাঁটবাঁধানো প্রাচীন পুকুর। ঘাটখানা প্রাচীন নয়। সিমেন্টে বাঁধানো বেঞ্চিতে কাপড় চোপড় রেখে শুভ জলে নেমে গেলো। তিলক বললো সে পুকুরে চান করে না। বাড়িতে গিয়ে গরম জলে চান করবে। শুভ অবাক হলো। এত নির্মল অথৈ জল রেখে কোন পাগলে বালতির জলে ডুব দিতে চায়। আসলেই লোকে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝে না। ঘাটের একপাশে বেলী ফুলের ঝাড়। বেলীফুলের ওপাশে লেবু গাছে অজস্র লেবু ফলে আছে। এক জায়গায় মাটি কালো হয়ে আছে। মোক্ষদা কি কাকীমা হয়তো প্রতিদিন সকালে এখানে বসে বাসি হাড়ি পাতিল মাজেন। ছাই ভরা ভাঙা মালসার উপর একটা শালিক এসে বসেছে। তিলক শীষ দিতে পাখিটি উড়ে গেলো। পাখিটা উড়িয়ে দিয়ে কি লাভ হলো তিলকের!

স্নান সেরে বাড়িতে ফিরলো তখন বেলা গড়িয়ে গেছে। উঠোনের মাঝে কাপড় শুকানোর দড়ি টাঙানো। শুভ কাপড় নেড়ে দিতে যাচ্ছে এমন সময়ে মোক্ষদা এসে বললো, আমারে দাদাবাবু। আমি নাইড়ে দিতিছি।
শুভ লক্ষ্য করে দেখেছে এখানে সবার কথায় আঞ্চলিক টান আছে। তবে তাদের সাথে কথা বলার সময়ে বিশুদ্ধ বাংলা ব্যবহার করছে। একমাত্র মোক্ষদা ব্যতিক্রম। আদি এবং অকৃত্রিম। সব সময়ে একই টোন। নো চেঞ্জ। তার উচ্চারণটাও মিষ্টি। কিন্তু কথা সে কমই বলে। সকাল থেকে দেখে যাচ্ছে একটা না একটা কাজ সে করেই চলেছে। কিন্তু তিলকের মত কখনো বলতে শোনেনি যে হাড়ে বাতাস লাগানোর সময় পাচ্ছে না। জানুয়ারীর এই শীতের দিনে হাড়ে বাতাস লাগানো! শিব শিব। ভাবলেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়।

দুপুরে খেয়ে দেয়ে শুভ তিলকের ঘরে গিয়ে শুয়েছি। একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব এসেছে। এমন সময়ে কারো উচ্চকন্ঠে শুভর ভাতঘুম টুটে গেলো। যাত্রাপালার বিবেক চরিত্রের মত তিলক যথাসময়ে এসে হাজির।
-   আরে দাদা এখনো শুয়ে আছো।
-   তো কি করবো?
-   কি আর করবা শুয়ে থাকো।
-   তাইতো আছি।
-   আরে বিয়ের ছাওয়াল। এত শুয়ে থাকা কেন। কোথায় ভাবী বউকে নিয়ে একটু চিন্তাভাবনা করবা। তোমার মনের মধ্যে কি হচ্ছে তা আমার সাথে শেয়ার করবা তা না সারাক্ষণ মন মরা হয়ে থাকো। সত্যি করে বলো তো তোমার কোন মনের মানুষ টানুষ নেই তো আবার। কাকাবাবু-কাকীমা জোর করে তোমার বিয়ে দিচ্ছে নাতো।
-   সেরকম কিছু না।
-   তবে কিরকম কি?
-   আরে। তুই এত পেঁচাস না!
-   এই দেখো। তুমি আমার অনুমতি ছাড়া তুই বলা শুরু করলে। না হয় হয়েছি বয়সে এক হাত ছোট তাই বলে তোমরা আমাকে একটু রেসপেক্ট করবে না। কবে যে আমি তোমাদের থেকে বড় হবো!
-   চেষ্টা করে দেখো। আমিও তো তোমার থেকে বয়সে বড় । কই তুমি তো আমাকে আপনি না বলে সেই শুরুর দিন থেকে তুমি করে বলছো।
টু দ্যা পয়েন্টে তিলক উত্তর দিতে না পেরে টপিকস ঘুরিয়ে দিলো।
-   আরে চলো। প্রজাপতি ঘটকিনি এসেছেন। তার দরাজ গলার আওয়াজে দেখছোনা সারা বাড়ি গমগম করছে।
-   প্রজাপতি ঘটকিনি কে?
-   উহ। ইনি কে তিনি কে! এত কে কে করলে শেষে তো তোমার গলার ভয়েস কাকের মত কা কা হয়ে যাবে। তখন কোন মেয়েই আর তোমাকে বিয়ে করতে চাইবে না। ইনি হচ্ছেন সেই সুবিখ্যাত ছোঁয়া ঘটকিনি। তোমার ত্রাণকর্ত্রী। চল যাই।
-   সেকি! তুমি পরমহিলাদের সামনে যাবে! মা-কাকীমা এরা বকবে না।
-   মাদের কাজই হলো বকাবকি করা, মেজাজ দেখানো। এসব আমলে নিলে চলে। জীবনটা তো মরিচ ছাড়া পান্তাভাত হয়ে যাবে। চলো চলো। কি কি কথা হচ্ছে না শুনতে পেলে আমার পেটের মধ্যে গুড়গুড়ানি শুরু হয়ে যাবে।
-   ওকে চলো তাহলে।

মিষ্টির প্লেটটা মোক্ষদা টেবিলের উপর নামিয়ে রাখতে কাকীমা বললেন, নাও বু। একটু মিষ্টিমুখ করো।
-   নাগো মেয়ে আমি তোমাদের বাড়ি কিছু খাবো না।
-   কেন কেন
কাকীমা ব্যগ্র হয়ে জানতে চাইলেন।
-   খাবো না। কারণ তোমরা মোচলমানদের ঘেন্না করো। তাদের বাড়িতে কিছু খাও না। তাইলি আমি ক্যান তুমাগে বাড়ি খাতি যাবো। ঘটকালি করি। ইডা আমার পিশা। তাই আইছি। ঘটকালি করবো। ফিস দিবা। খুশী হয়ে বকশিষ দিবা। তাও নেবো। কিন্তু খাতি পারবো না। এই আমি কয়ে দিলাম।
-   ঘেন্না করে খাইনে তা কিন্তু না বু। শাস্ত্রে নিষেধ আছে। তাই খাইনে।
-   মানুষ থেকে মানুষকে আলাদা করে ফেলে সে আবার কিরাম শাস্তর তা আমার মাথায় ঢোকে না। ঐ মোল্লা আর বামুন কডা মিলে কি সব ধর্ম ধর্ম করে বেড়ায় সারাদিন। কোন ধর্ম কি কইছে যে মানুষরে ঘিন্না করো।
শুশীলা, যশোদা মানে তিলকের মা দুজনেই মাথা নেড়ে সায় দিলেন, না বলেনি।

-   “পান তো খাবা”? ঘর থেকে বের হয়ে মোড়া টেনে বসতে বসতে প্রিয় কাকু জিজ্ঞেস করলেন। পান মনে হয় ছোঁয়াবুর প্রিয় খাদ্য। পানের রসে গাল লাল হয়ে আছে। এতক্ষণে ছোঁয়া বুর দিকে তাকানোর অবকাশ পেলো শুভ। লাল রঙটাই বুঝি তার প্রিয়। কটকটে লাল রঙের বোরখা পরে আছে সে। তিলক ফিসফিসিয়ে টীকা দিলো যে এই লাল বোরখা হচ্ছে ছোঁয়াবুর ট্রেডমার্ক। ঘটকদের ঐতিহ্যবাহী সিম্বল ছাতা। ছোঁয়াবুর ছাতাখানাও লাল। যে চেয়ারে বসেছেন ওটার হাঁতলে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন ছাতাবাবুকে।

পানের কথা শুনে ছোঁয়াবু বললেন, পান। তা পান না হয় এট্টু খালাম। তুমরা যহন এত্ত করে কতিছো। তা কই ছাওয়ালডারে ডাহো। এট্টু দেহি। পাত্রীপক্ষগো যায়ে কতি হবে না ছাওয়াল দেখতি কিরাম। ছবি দেখে কি আইজকাল আর বিয়ে সাদী হয়। কি সব ফটোশপ না ঘোড়ার ডিম আছে তাই দিয়ে নাকি কালা ছাওয়ালরে ফর্সা বানাই দিতেছে শুনি।

শুভবিবাহ-০৯
লীলাবালি লীলাবালি বড় যুবতী সই গো কী দিয়া সাজাইমু তোরে ?
মাথা চাইয়া টিকা দিমু জড়োয়া লাগাইয়া সই গো. কি দিয়া সাজাইমু তোরে
নাক চাইয়া নাকফুল দিমু পান্না লাগাইয়া সই গো. কি দিয়া সাজাইমু তোরে - পুরাতন দিনের বিয়ের গান।
যশোদা দেবী তিলক দাশগুপ্তকে ভয়েস মেসেজ পাঠিয়ে দিলেন সরাসরি, কই তিলু, কই গেলি, শুভকে একবার এদিকে নিয়ে আয়। তিলক শুভকে বললো, “চলো দা”। শুভ সংকুচিত হয়ে বললো, “তিলু, আমার না খুব লজ্জা লাগছে”।
-আহ ছোড়ার ঢং দেখে তো শরীর জ্বলে গেলো। পাত্রীপক্ষের সামনে তো আর যাচ্ছো না। যাচ্ছো ঘটকিনির সামনে তাতে এত লজ্জার কি আছে। কি সব নেকুপনা তোমরা করো না। আর বিঁটকেলে ঢুমসি টার আবার কচি পোলাটারে দেখার শখ হইলো ক্যান। তুই ঘটকালি করবি। দুই দিক থেকেই কমিশন খাবি। ছাওয়াল দেখতি কালো না বিড়াল তাতে তোর কি যায় আসে। যত্তসব।
- এভাবেই যাবো?
- তো কিভাবে যাবা? স্নো ক্রিম পমেডম মাখবা?
- আরে ভাই খেপছো ক্যানো! এমনি বললাম।
- চল-লো!
- চলো।

শুভ ঘটকিনির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। এতো মুসলিম। সালাম দেবে নাকি নমস্কার করবে শুভ বুঝে উঠতে না পেরে একবার মায়ের দিকে আরেকবার কাকীমার দিকে তাকায়। বাংলাদেশে মুসলিমরা কিভাবে সালাম দেয়? সিরাজুদ্দৌলা নাটকে যেমন বামহাতে কান চেপে ধরে ডান হাত নাক বরাবর বার কয়েক আপডাউন করে যে সালাম দেয়ার সিন আছে ওভাবেই সালাম দিতে হবে নাকি। তিলকই শুভকে এই যাত্রায় উদ্ধার করে দিলো।
-   সালামালাইকুম ছুয়া পিসি। ভালো আছেন?
ভারতীয় উপমহাদেশের বাসিন্দারা দৈনন্দিন জীবনে কেউই কট্টর ধার্মিক নয়। যাপিত জীবনে ধর্ম একটা অনুসংগ তাই পালন করে। ধর্মের জন্য জান দেয়া বা নেয়ার সংখ্যা খুবই নগন্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় কিছু সুযোগ সন্ধানী লোকের কানপড়াতেই এরা ধর্ম রক্ষা করতে উঠে পড়ে লাগে। তবে বাসিন্দারা সবাই অন্তরে একেকজন হিন্দু মুসলমানযতই অসাম্প্রদায়িকতার বুলি কপচাক না কেন সময়ে অসময়ে ঠিকই হিন্দু মুসলিম পরিচয়ের মধ্যে গুটিয়ে যায়। ছোঁয়া ঘটকিনি কোথায় যেন শুনেছে হিন্দুর সালামের জবাব দিতে নেই। তাই সে সহাস্যে মাথা ঝাঁকি দিয়ে পরিস্থিতি ট্যাঁকল দিলো। ঘটকালি বিদ্যার প্রধান শিক্ষা হচ্ছে অন্যের মনঃস্তত্ত্ব বুঝতে পারা এবং সেই ব্যালান্সে পরবর্তী বাক্য ডেলিভারি করা।

শুভকে দেখার পর ছোঁয়া ঘটকিনি বললো, সোবানাল্লাহ। এযে দেখতিছি রাজপু্ততুর। এই ছেলের জন্যি পাত্রীগে লাইন লাইগে যাবে এই আমি কয়ে দিলাম। তা বাবা লিখাপড়া কদ্দুর কইরলে?

সুশীলা সেনই উত্তর দিলেন, আমাদের ছেলে বিএ পাস।
ছোঁয়া ঘটকিনি বললো, বাহ বাহ! বিএ পাস দেছো এবার বিয়ে পাসও হইয়ে যাবেনে। যাও বাপু। ঘরে গে বিছরাম করো গে। 

শুভ ঘরে চলে গেলো। ছোঁয়া ঘটকিনি সুশীলার দিকে ফিরে বললো, একটা কতা সত্যি করে কন দেহি পোলার কোন সমইস্যা টমইস্যা নেই তো! এই পোলা কইলকাতার তে এইহানে আইনে বিয়ে দিতিছেন ক্যান? সব ভাই খুলাখুলি কইয়েন। লুকো ছাপা করবেন না কলাম। আমি ভাই দাগী ফলের কারবার করিনে। সিরাম কিছু থাকলি আগে ভাগে কয়ে দেন।
এবার প্রিয় বাবুই মুখ খুললেন, আরে বু। কি যে বলো না তুমি। দাদারে তো তুমি দেখছোই। দ্যাশের প্রতি তার কিরাম টান। সেজন্যই দাদা চাতিছে ছাওয়ালডা এই দ্যাশে বিয়ে দিয়ে দেবে।
-   তা হলে সেই কথাই থাকলো। চৌধুরীদের বলি কাল সন্ধ্যায় ছাওয়াল দেখতি আসতি। তারপর আল্লার ইচ্ছায় সব যদি উকে হয়ে যায় তালি আপনাগো পাঁজি টাজি দেইখে দিন ফালায়া দিয়েন। যাই তালি।

নিস্তব্ধ বিকেল। বাড়ির উঠোনে এখন একরাশ নিঃসংগতা। কে কোথায় আছে কে জানে। তিলক এতক্ষন বকরবকর করছিলো। এখন মনোযোগ দিয়ে অংকখাতার পেছনের পাতায় গোলাপ ফুল আঁকাচ্ছে। বাইরে থেকে ঘড়ঘড় কন্ঠে আওয়াজ এলো, ও পিয়ো, পিয়ো। বাড়ি আছিস নাকি।

শুভ জানালার দিকে গলা বাড়িয়ে দেখলো। ময়লাটে সাদা থান কাপড় পরা এক বৃদ্ধা লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। কপালে চন্দনের ফোঁটা। হাঁটতে বেশ কষ্ট হয়। চোখের উপর গোল গোল মোটা কাঁচের চশমা। কারো কোন সাড়া নেই। সেই বারান্দার সিড়ির উপর বসে পড়লো। শুভ হাত দিয়ে তিলককে নাড়া দিলো। তিলকের কলম সরে গিয়ে গোলাপ ফুলের মাঝ বরাবর দাগ পড়ে গেলো।
-   ধ্যাৎ, দিলে তো সব পন্ড করে। ডাকার জন্য ভগবান মুখ দিছে। আমার এত সুন্দর একখান নাম দিছে। তা রেখে হাত দিয়ে এত গুতোগুতি কিজন্য। বিয়ের পর যত খুশী বউকে গুঁতিয়ো।
শুভ অপ্রতিভ হয়ে বললো, দেখো বাইরে কে যেন এসেছে। তিলক রাঁজহাসের মত গলা লম্বা করে বললো, ওহ। ও তো ক্ষেমি।
-   ক্ষেমি! তুমি সবারই নাম ধরে ডাকো।
-   একই ডায়ালগ কি আবার দিতে হবে?
-   তো এই ক্ষেমি কে বলো শুনি। যদি না তোমার কথা বলতে কোন কষ্ট হয়?
-   ইনি হচ্ছেন বাবাদের ক্ষেমি পিসি। ঠাকুরদাদের বোন। শুনেছি একশোর উপর বয়স। তোমার তো আবার কারো বয়স শুনলে তার আবার বার্থ সার্টিফিকেট লাগে। ইনার বয়সের কিন্তু বার্থ ডেথ কোন সার্টিফিকেট নেই। অল্প বয়সে বিধবা হয়ে বাপের বাড়ি ফিরে এসেছিলেন তারপর এই গ্রামে হেঁটেই তার জীবন কেঁটে গেছে। চোখে ভালো না দেখলে কি হবে সবাইকে চেনেন। দেখো কাকাবাবুরা এসেছেন এই খবর কারো মুখে শুনে চলে এসেছেন।
-   বাবাদের পিসি। তাহলে থাকেন কোথায়।
-   আসলে উনি ঠাকুরদার আপন বোন না। পিসতুতো বোন। ওপাড়ায় শম্ভুকাকাদের বাড়ি। ওখানেই থাকেন।

যশোদা বেড়িয়ে এসেছেন ঘর থেকে। ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বোধহয়। ঘুমজড়ানো চোখে বললেন, ও মা । পিসি দেখছি। কখন এলে? এতদূর কিভাবে এলে? কার সাথে এলে? ঠান্ডায় সিঁড়ির উপর বসেছো কেন। উপরে উঠে বসো।
_ এই পাড়ার কৃষ্ণ গাংগুলির ছাওয়াল আছে না। অনুপ। সে বেহান বেলা সারকেল চালায় যাতিলো আমাগে বাড়ির সামনে দে। আমারে দেইখে কইলো, ও দিদি শুনিছাও তোমার ভাইপো আইছে। দেখতি যাবা না। শুনে খুব আসতি ইচ্ছে করলো। পেত্থমে ভাবিলাম এরা তো দুতিনদিন থাকপেনে। আস্তে ধীরে আসপানি। তা মন টাইনলো। বাড়ির ছাওয়াল পাওয়াল কডারে সাধলাম। সব কিরকেট ফিরকেট নিয়ে ব্যস্ত। কলো তুমার যাতি ইচ্ছে করে তুমি যাও। আইজকালকের পুলাপাইন সব রক্তের সম্পর্ক বোঝে না। তাই একাই বেরোইলাম। হাঁটতি হাঁটতি আসতিলাম। আইজকাল তো ভ্যানগাড়ি হইছে। মফেজ আছে না। শাহজুদ্দির ছাওয়াল। আমারে কইলো কনে যাবা। তুমাগে বাড়ি আসবো শুনে আমারে নামায় দিয়ে গেলো। হাতে পয়সা ছিলো না বলে ওরে কিছু দিতি পারলাম না। কইছি বাড়িতে আসতি। পয়সা দিবানে।

বাড়ির কথা বলায় যশোদা জিজ্ঞেস করলেন, তা বাড়িতে কয়ে আইছো তো?
-   হাহ। বাড়ি। বাড়ির লোক আমার জইন্য চিন্তা কইরে সব চিন্তামনি হইয়ে থাকপেনে কিনা। গোবিন্দ কনে। ওরে ডাকো। একটু দেখি।

গোবিন্দ এসে পিসিমাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। সেই কোন ছোটবেলা বাবার হাত ধরে সে এই এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। সব কিছু বদলে গেছে। স্মৃতি হাঁতড়ে সেই ফেলে যাওয়া গ্রাম কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলো না। সেই গ্রামকে ফিরে পেলো পিসির মুখ। পিসিমার বয়স হয়েছে। গাল তুবড়ে গেছে। কিন্তু চেহারা অবিকল যেন আগের মত আছে। গোবিন্দের চোখ সজল হয়ে উঠলো। পিসিমা গোবিন্দের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। “আরে গোবি তুই যে অনেক বড় হয়ে গেছিস। আমার কথা মনে আছে তোর। ছেলে বেলায় তোকে কত কোলে কোরে নিয়ে ঘুরতাম। মনে আছে তোর”।

ঝাঁপসা চোখে পিসিমা গোবিন্দের মুখখানা ঠিকমত ঠাওর করতে পারছিলেন না। গোবিন্দের মুখে বারবার হাত বুলাচ্ছিলেন। গোবিন্দ পিসিমাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো।




শুভবিবাহঃ পাত্রদেখা
মেয়েরা আশা করে ছেলেরা বিয়ের পরে বদলাবে, কিন্তু তা হয় না আর ছেলেরা আশা করে মেয়েরা বিয়ের পরেও একইরকম থাকবে, কিন্তু তারা বদলে যায় - বিয়োক্তি
তিলক তাড়া দিলো, ন্যাও ন্যাও জলদি গুছিয়ে ন্যাও। আর কত দেরী করবা! পাত্রীপক্ষ এসে পড়লো বলে। চক্কোত্তিগিন্নি নাকি সব কাজ ঘড়ি ধরে করেন। সাড়ে সাতটায় আসবে বলছে দ্যাখপা ঠিক সাড়ে সাতটায় এসে গেছে। তার পায়েও মনে হয় ঘড়ি ফিট করা। শুভ তিলকের কথা পাত্তা দিলো না। যদিও তার ইচ্ছে করছে না। তবুও অনিচ্ছা সত্ত্বেও যখন এতদূর এসেছে তখন বাকীদূরও যেতে হবে। সে নিজের লাগেজ খুলে দেখছিলো। কোনটা পরবে। তার কাপড়চোপড় দেখে তিলক বললো, তোমাদের কলকাতায় অনেক অনেক দোকানপাট তাই না।
-   হ্যাঁ। তোমাদের এখানেও তো আছে।
-   আছে। কিন্তু সে তো খুলনা টাউনে। সব সময় তো আর যেতে পারিনে। লোকাল মার্কেট থেকেই কিনতে হয়।
-   চলো একদিন দুজন মিলে খুলনা চলে যাই।
-   হাহ। যেতে দিলে তো হয়। যশোদা রাণীরে তো চেনো নাই। চুপ চাপ থাকে বলে ভোলাভালা মনে করতেছো। তার মতের বাইরে গেলে যে কি মূর্তি ধারণ করে তা তখনই দেখতে পাবা।
-   কি যে বলিস না তুই। কাকীমা একদম অন্যরকম। শান্ত শিষ্ট।
-   লেজ বিশিষ্ট।
-   নিজের মা কে নিয়ে ইয়ার্কি মারতে তোর লজ্জা লাগে না।
-   নিজের বলেই তো করি। অন্যের মা কে নিয়ে ইয়ার্কি মারতে যাবো সেরকম ব্যদ্দপ ছেলে আমি তিলক নই।

সাড়ে সাতটার কিছু আগে চক্রবর্তী পরিবার পাত্র দেখতে এলেন। এ কয়দিন চার পাশে অপরিচিত মুখ দেখতে শুভ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু ওঘর থেকে ছোঁয়া ঘটকিনী যখন ডাক দিলো, “কই ছেলেকে নিয়ে আসো”। তখন শুভর দুই পা যেন অসাড় হয়ে গেলো। সে অসহায়ের মত তিলকের দিকে তাকালো। ফিঁচকে তিলক কি বুঝলো কে জানে। সে শুভর কাঁধে হাত রেখে বললো, “ভয় পাচ্ছো কেন! আমি আছি না। মেয়ে যদি তোমাকে গিলে খেতে চায় তবে গলায় পাড়া দিয়ে চেপে ধরবো যাতে গিলতে না পারে”। তিলক এমন ভাবে হাত পা ছুড়ে কথা বললো, যে শুভর মনের এই দশাতেও হাসি পেলো।

ধীর পায়ে সে বৈঠক ঘরে প্রবেশ করলো। পুরোনো আমলের সোফার উপর বসেছে পাত্রী এবং তার পরিবার। ঘটকিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন, এ হচ্ছে পাত্রীর মা, ইনি বাবা, ইনি, খুড়ো, আর এই হচ্ছে সুষমা। আর চক্কোত্তি গিন্নি এই হচ্ছে আমাদের হীরের টুকরো ছেলে। ঘঁষে দেখতে পারো। কোন ভেঁজ়াল নেই। এক্কেবারে খাঁটি। বাড়ির সব খানা চেয়ার এই ঘরে জড়ো করা হয়েছে। বাড়ির সবাই তো উপস্তিত আছে। আরো আছে পাশের বাড়ির পরিমল কাকু। বেশ চুপচাপ স্বভাবের মানুষটি। গলার স্বর অসম্ভব রকম মধুর কিন্তু খুবই কম বাক্যব্যয় করেন মনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করতে।

পাত্রীসহ পাত্রীর বাবা মা সবার সামনেই ড্যাবড্যাব করে শুভকে দেখতে লাগলো। শুভর খুব অসস্তি লাগতে লাগলো। তিলক বিড়বিড় করে বললো, “পূঁজোর পাঠার মত এত দেখার কি আছে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে না কেন”। সবার আগে ছোঁয়া বুই কথা বললো, “আরে যশোদি তোমার পোলাও তো বিয়ের লাহান হইছে। কও তো খোঁজ লাগাই। ভালো পাত্রী আছে হাতে”।
তিলক বাঁশ ফাঁটার মত ঠাশ করে বলে উঠলো, আগে যে খানা কচ্ছেন ওখানাই শেষ করেন দিকি। তারপরে নাহয় পাশের টার দিকে নজর দিয়েন।
-   বাহ, বাহ, দিদি পোলা তো তোমার সেইরাম চালু হইছে। চক্কোত্তি গিন্নি আপনাদের কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলি জিজ্ঞেস কত্তি পারেন। সবাই এখানে আছেন।
নাহ। চক্কোত্তি গিন্নিদের বিশেষ কিছু জিজ্ঞেস করার ছিলো না। পোষাক আষাকের বাহার বলে দিচ্ছে হয়তো পয়সা জমিয়ে নতুন বড়লোক হয়েছেন কিন্তু আচার ব্যবহারে সেরকম বড়লোকি আয়ত্ত্ব করতে পারেন নি। তাদের ব্যবহার বড় মেকি ঠেকলো শুভর কাছে। চক্কোত্তি মশাই শুভকে গদবাঁধা প্রশ্ন করে গেলেন। নাম কি, বাড়ি কোথায়, বাবার নাম কি? গান গাইতে পারে কিনা? কতদূর পড়াশুনা করেছে।

হাতের লেখা পরীক্ষা করতে শুভকে একটা কাগজে নিজের ঠিকানা লিখে দিতে হলো। সেই হেঁটেই এসেছিলো। কিন্তু তাকে আরো একবার দাঁড়াতে বলা হলো। শুভর বুঝতে বাকী রইলো না যে তার হাইট দেখলো। সব কিছু দেখা হলে পরে তিলককে বলা হলো, শুভকে নিয়ে যাও। তাকে নিয়ে যেতে হবে কেন! সে নিজেই যেতে পারে।

তিলকের ঘরে ফিরে যেতে যেতে তিলক শুভকে কনুই দিয়ে খোঁচা দিলো। পাত্রী কেমন দেখলে? পছন্দ হলো।
-   আমার পছন্দে কি যায় আসে!
-   কি যে বলো না! অপছন্দ হওয়ার কি আছে। আমার তো বেশ পছন্দ হয়েছে।
-   তবে তুইই বিয়ে করনা।
-   করতাম যদি পাত্রী রাজী থাকতো। যে ভাবে তোমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকাচ্ছিলো মনে হচ্ছিলো যে কাঁচাই গিলে খাবে।
-   তোর বেলা খাওয়ার আগে নুন ছিটিয়ে দিতে বলবো।
-   সত্যি করে বলতো তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা!
-   জানিনা!
-   বুচ্চি বুচ্ছি। লুইজ্জা পাচ্ছো। পাও পাও। লজ্জাই পুরুষের ভূষণ।

কিছুক্ষণ পর তিলক ফিরে এসে শুভকে ধারাভাষ্য দিয়ে গেলো যে পাত্রীপক্ষ এখনি কোন ফলাফল ঘোষণা করছেন না। দিন দুয়েক বাদে তারা জানিয়ে দেবেন। কিন্তু শুশীলা বেগম টেনশান করছেন দুদিন বাদে যদি বলে পছন্দ হয়নি তবে বেকারই দুদিন বসে থাকা হবে। ছোঁয়া ঘটকিনি জানিয়ে গেছেন, টেনশানের কোন কারণ নেই। আগামীকাল তিনি আরেকপক্ষকে হাজির করবেন। সো তোমার সাজপোষাক খোলার দরকার নেই।
-   ভাগ এখান থেকে।
-   ভাগলাম এখান থেকে। কিন্তু একটা জিনিস আমার মাথায় ঢুকছে না।
-   কি এমন জিনিস যা তোর মাথায় ঢোকে না!
-   আচ্ছা ধরো। আজকে এরা দেখলো। কালকে তারা দেখবে। যদি দুপক্ষরই তোমাকে পছন্দ হয়ে যায় তখন কি হবে। চর দখলের মত তোমাকে দখল নিয়ে শেষে না লাঠালাঠি শুরু হয়।
-   সমস্যা নেই। আজকের এদের তো তোর খুব পছন্দ হয়েছে। কাকীমাকে বলে তোকে এদের হাতে গছিয়ে দেবো।
-   হু। কালকের পার্টি যে এদের থেকে ভালো হবে তা তুমি কিভাবে জানছো।
-   অত কিছু জানতে হবে না। খুব খিদে পেয়েছে। দেখতো খাওয়ার কিছু ব্যবস্থা করতে পারিস কিনা।
-   আমচুর খাবে?
-   এই শীতের দিনে আমচুর!
-   শীত ফিত বুঝিনা। খাবে কিনা বলো। বাড়িতে তৈরী। একদম ফ্রেশ।
-   নিয়ে আয় তবে।

মোক্ষদা চায়ের ট্রে নামিয়ে রেখে গেলো। যশোদা শুশীলার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে বললো, তুমি অযথাই চিন্তা করছো দিদি। চিন্তার কিছু নেই। ছেলে হয়ে যখন জন্মেছে। কোন মেয়ের হাতেই তো ওকে তুলে দিতে হবে। দেখে শুনে ভালো কোন মেয়ের হাতেই ওকে তুলে দাও।
 শুশীলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, যা দিন কাল পড়েছে দিদি। বাইরে থেকে দেখে কি আর লোক চেনা যায়। খুব ভয় হয়। ভূল কোন মেয়ের হাতে গিয়ে পড়বে নাতো ছেলেটা! ভূল কিছু করছি না। একমাত্র ছেলে আমার। ওর বাপের কথায় নেচে এতদূর চলে এলাম।

শুভর বড়মামা কথা বললেন, দিদি তুমি অযথাই চিন্তা করছো। এই চিন্তা আরো আগে করা উচিত ছিলো। এখন যেহেতু এই চিন্তা অর্থহীন তখন আমরা বর্তমানকে নিয়েই চিন্তা করি। কালকের ওরা আসুক। দেখা যাক।

ছোটকাও মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালো।   

শুভবিবাহঃ ১১
ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা
সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে যে স্মৃতি দিয়ে ঘেরা
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি
সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি।। - দীজেন্দ্রলাল রায়

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতে শুভ দেখতে পেলো তিলক বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। আলসেমি জড়ানো স্বরে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাচ্ছো?
-   ইস্কুলে যাচ্ছি। তোমার বিয়ে উপলক্ষ্যে তো জাতীয় ছুটি ঘোষণা করা হয়নি যে স্কুলে যেতে হবে না।
-   বাব্বাহ! সব কিছুর উত্তর এত জটিল করে দাও কেন!
-   কারণ আমি মানুষটাই জটিল।
-   আচ্ছা আমি কি তোমার সাথে যেতে পারবো?
-   হ্যাঁ পারবে। কিন্তু তুমি গিয়ে কি করবে! ইস্কুলে যেতে কারো আবার ইচ্ছে করে নাকি! ইশ সেই দিন যে কবে আসবে যেদিন থেকে আমাকে আর স্কুলে যেতে হবে না।
-   স্কুলে যাওয়ার মজা যে কি তা সেদিনই বুঝবে যেদিন তোমার স্কুলজীবন শেষ হয়ে যাবে।
-   থাকো তুমি তোমার মজা নিয়ে।
-   বাড়িতে শুয়ে বসে থেকে খুব বোর লাগছে। তোমাদের গ্রামটাই দেখা হলো না।
-   গ্রামের কি ছাই দেখবে। আমার তো শহর দেখতে ভালো লাগে। ইশ কবে যে ঢাকা শহর দেখতে যেতে পারবো। শুনেছি অনেক বড় শহর। আমাদের খুলনার থেকেও অনেক বড়। অনেক মানুষ আর অনেক অনেক শপিং মল। ইচ্ছেমত কেনাকাটা করবো।
-   যখন শহুরে ধুলো বালিতে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে তখন বুঝবে এই গেঁয়ো জীবনের নির্মল বাতাসের মূল্য।
-   তুমি কি সত্যিকারে আমার সাথে স্কুলে যেতে চাও?
-   মিথ্যাকারে আবার যাওয়া যায় নাকি!
-   তবে পিন্ডি এখনো শুয়ে আছো কেন। সাড়ে সাত মিনিটের মধ্যে উঠে রেডি হয়ে নাও। আমার হাতে আর বেশী সময় নেই। পিটির আগে না পৌঁছলে টাইগার স্যার পিঠে বেত ভাঙবে। পুরুষ মানুষ হয়েও টাইগার স্যার এত রাগী হলেন কিভাবে আমার মাথায় আসে না।

সাড়ে সাত মিনিটে না হলেও শুভ রেডি হয়ে নিলো। খুব বেশী দেরী হয়েছে এমন না তবুও তিলক কয়েকবার বকাঝকা করে গেলো। অবশ্য এই কয়দিনে তিলককে দেখে শুভর ধারণা হয়েছে যে এই চরিত্রের বাইরে তিলককে মানায় না। স্কুল বাড়ি থেকে বেশ দূরে। হাত ঘড়ির পানে চেয়ে দেখলো হাতে সময় আছে। পায়েও সময় আছে। তিলকের স্কুল শুরু দশটায়। এখন নটা বাজে। তিলক শুভকে জিজ্ঞেস করলো, গাড়িতে যাবে?
-   গাড়ি! এদিকে তো সেভাবে গাড়ি চলতে দেখি না।
-   ওরে আমার কইলকাত্তার বাবু লো। গাড়ি নেই তো কি। রিকশা নেই। ভ্যানগাড়ি আছে। আমরা ভ্যানগাড়িতে চলি।
-   হাতে তো সময় আছে। চলো হেঁটে যাইনা।
-   আমার কোন আপত্তি নেই। মায়ের কাছ থেকে ভ্যানের ভাড়া নিয়ে এসেছিলাম। ওটা দিয়ে ফুচকা খাওয়া যাবে।
-   হা হা হা। তাই খেয়ো।

অনেকটা পথ হেঁটে আসার পরে একটা খাল পড়লো। খালের দুই পারেই রাস্তা। দুই সাইড দিয়েই যাওয়া যায়। তিলক শুভকে শুধালো কোন পার দিয়ে যাবে?
-   দুই পারের স্পেশিয়ালিটি কি?
-   এই যে এপারে দেখছো পিচের রাস্তা। স্মুথ পথ। স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটতে পারবে। কিন্তু ভ্যান, সাইকেল, মোটর সাইকেলের ছোটাছুটি লেগেই আছে। ওপারে ইট বিছানো রাস্তা। নিরিবিলি। সবাই ভালো পথ দিয়েই চলে কিনা!
-   ইশ, মাটির রাস্তা হলে ভালো হতো। ওপার দিয়েই যাবো চলো।

মরা খাল। শীতকাল বলে পানি একদম কমে এসেছে। শুভ দুপাশ দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছে। তিলক আপনমনেই ওর স্কুলের কোন ঘটনা হড়বড় করে বলে চলেছে। খালের পানিতে তিনটি হাঁস সাঁতার কাটছে। হাঁসেদের কি সাঁতার লাগে না! শুভ একমনে হাঁস দেখছে বলে, তিলক বললো, কি হাঁস দেখে জিভে জল চলে এলো। হাঁসের মাংস খাবে? দাঁড়াল বাড়িতে ফিরেই বাবাকে বলছি। ব্যবস্থা করতে।
-   আরে না না। আমি এমনিতে খুব একটা মাংস খাই না। দ্যাখো না হাঁসগুলো পানিতে কি সুন্দর লাগছে।
-   সুন্দর জিনিসই খেতে হয়। সুন্দর হচ্ছে ভালোর প্রতিশব্দ। যে তরকারী ভালো রান্না হয় সে জিনিসই মানুষ বেশী করে খায় আর বলে সুন্দর সুন্দর।
-   কাকীমাকে বলবো তোকে উকিল বানাতে। আমি নিশ্চিত কোন এডভোকেটই তোকে কোনদিন হারাতে পারবে না।

এক জায়গায় খালের উপর একটা বরই গাছ কাত হয়ে আছে। জল ছুই ছুই দশা। দুটো ছোট মেয়ে পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য একটি মেয়ে সেই কাঁত হয়ে যাওয়া গাছের উপর দিয়ে ত্রস্তপদে বরই পাড়ার চেষ্টা করছে। স্কুল খুব কাছে চলে এসেছে। স্কুল ড্রেস পরা ছেলে মেয়দের আনাগোনা বেশ চোখে পড়ছে। সব ঝাঁক বেঁধে ছোট ছোট দলে আলাদা হয়ে গল্প গল্প করতে এগিয়ে চলেছে। এক জায়গায় কয়েকটা মেয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। ওদেরকে দেখে তিলক একটু সংকোচিত হলো। শুভ ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কারা এরা?
-   বখাটে মেয়েরা।
-   এখানেও?
-   বখাটে মেয়েদের কোন দেশ, কাল, পাত্র নেই। এরা আদিতেও ছিলো, অন্তেও থাকবে। সব দেশে সব সমাজে এদের পাবে।
-   এখন কি করবে।
-   কি করবো। পাস করে যাবো। ডাক দিতে পারে। শিশ দিতে পারে। শার্টের কোনায় টান দিতে পারে।
-   ভয় করে না তোমার?
-   ভয় করে কি হবে। পালিয়ে কি বাঁচা যায়। আর এদের ভয় করার কিছুই নেই। আমি তোমাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছিলাম।

ওদের কাছাকাছি হতে, কালো করে লম্বা মেয়েটা ডাক দিলো, এই তিলক এদিকে আয়।
শুভ এগিয়ে গেলো। হাসার চেষ্টা করলো। এই হচ্ছে শুভ্রা। তিন তিন বার টেস্ট পরীক্ষা দিয়েও ম্যাট্রিকে বসতে পারলো না। ওর পাশে দাঁড়ানো ঐ বাঁটুল সাইজের মেয়েটার নাম কৃষ্ণা। ভীষণ বদরাগী। সারাক্ষণ সিগ্রেট ফোঁকে। গাঁজাও খায় শোনা যায়। ও কবে লাস্ট স্কুলে গেছে তা তিলকের মনেও পড়ে না। সাথে তো আরো দুই উর্বশী থাকে। তাদের দেখা যাচ্ছে না কেন। এরা সবাই এই স্কুলের ছাত্র ছিলো। একদা তাদের মত প্রতিদিন স্কুলের ড্রেস পরে স্কুলে যেত। কিন্তু এদের জীবনটা যেন এই স্কুলে যাওয়ার পথের মাঝেই এসে শেষ হয়েছে। না পারেনি বাড়ি ফিরতে না পারেনি স্কুলে পৌঁছাতে।
-   কেমন আছো শুভ্রা আপু।
-   ভালো। তোর সাথে এটা কে?
-   আমার দাদা। কোলকাতা থেকে এসেছে।
-   ওহ তাহলে এর কথাই শুনেছিলাম। কোলকাতা থেকে বিয়ে দিতে নিয়ে এসেছে। কেমন আছো ভাইডি? আমাদের গ্রাম কেমন লাগছে তোমার?

শুভর হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। যে ঝামেলায় তাকে কলকাতা ছাড়তে হলো সেই একই সমস্যা এখানেও ফেস করতে হচ্ছে। তাহলে কি আবারো তাকে সেইসব সুইসাইডের ঝামেলায় যেতে হবে। না না না। এত দ্রুত সে মরতে পারবে না। তার বাঁচার শখ অনেক দিনের। পৃথিবী অনেক সুন্দর। যদি কখনো সুযোগ আসে তবে সে পৃথিবীর সব কোনা কাঞ্চি পর্যন্ত ঘুরে দেখতে চায়।

সে কোনমতে জবাব দিলো, “ভালো”। এই শীত সকালেও শুভর কপোলে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। 

শুভবিবাহ- ১২
যখন পড়বে না মোর পায়ের  চিহ্ন এই বাটে,.
আমি বাইব না মোর  খেয়াতরী এই ঘাটে,.
চুকিয়ে দেব বেচা কেনা,. মিটিয়ে দেব গো,
মিটিয়ে দেব লেনা দেনা,.
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে--.
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে -  প্রিয়কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ওপাড়ার মসজিদে আজানের সুর মিলিয়ে যেতেই তিলকদের বাড়ির ক্ষুদ্র মন্দির থেকে ঘন্টা, শাঁখ আর উলুধ্বনির সম্মিলিত সুর ভেসে এলো। খাঁটের উপর শুভ নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তিলক টিভি ছেড়ে দিয়ে গেছে। ভলিউম কমানো। পর্দায় সংবাদ পাঠিকার ঠোঁট নাড়া দেখতে পাচ্ছে। শুভ খেয়াল করে দেখেছে বাংলাদেশ টেলিভিশন আর দুরদর্শনের খবরের ধরণের খুব বেশী পার্থক্য নেই। সবারই এক থিম। সরকারের উন্নয়ন সংগীত। যুগ কাল সময় বদলে যাচ্ছে, যাবে কিন্তু এই সরকারী চ্যানেল গুলি বুঝি এমনি রবে। পানসে বলো, মন খারাপ করা বলো আর নিরামিষ সন্ধ্যা বলো, খুব বোর লাগছে শুভর। সকালের ঘটনাটা কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারছে না। সবখানেই খারাপ আছে, খারাপ মানুষ আছে। পালিয়ে বাঁচা যায় না। জীবন থেকে হয়তো পালিয়ে যাওয়া যাবে। দূরে। অনেক দূরে। হয়তো পৃথিবীর ওপারে। কিন্তু তাতে কি হবে। কারো কিছু আসবে যাবে না। সবাই দুবেলা খাবে দাবে ঘুমাবে। তিলক এই বারান্দায় বসে রবীসংগীত গাইবে, যখন পড়বেনা মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে। এমনি করে সন্ধ্যা নামবে। তখন না হয় নাইবা মনে করলে।

তিলক ঝড়ের বেগে এসে হাজির। এখনো রেডি হওনি। জলদি হও।
-   ভালো লাগছে না কিছু।
-   ইহজগতে এমন কিছু আছে কি যা তোমার ভালো লাগে বলে শুনেছি বলে মনে হচ্ছে না।
শুভ লক্ষ্য করে দেখেছে বাংলাদেশের হিন্দুদের মধ্যে সাবলীল ভাবে অনেক ইসলামী শব্দ ব্যবহার করছে দৈনন্দিন জীবনে। কিছু ক্ষেত্রে বাঙালী হিন্দু মুসলমান তো দা কুমড়ো সম্পর্ক ধারণ করেছে। বাঙালী হিন্দু বাদে সকল হিন্দুই জলকে পানি বলে চলেছে অবলীলায়। কিন্তু বাঙালী হিন্দুর কিছুতেই পানি বলা চলবে না। অন্যদিকে মুসলিমদের একই দশা। পারলে তো জলপাইকে পানিপাই করে ছাড়ে। হঠাৎ কলকাতার মুসলিমদের কথা মনে পড়ে গেলো। তারা যেমন অনেক হিন্দুবাচক বাংলা বলে যা এখানকার মুসলমানরা বলে না। এখানে মুসলিমরা স্নানকে গোছল বলে আবার শিলিগুড়ির রুবেল সে তো কলকাতার অন্যান্য হিন্দুদের মতই গোছলকে চান করা বলে। এই ভাষার খেলা। ভাষার কোন জাত ধর্ম নেই। আমরাই একে রঙের প্রলেপে আলাদা করে ফেলি।

-   কি ভাবছো? ওঠঠো।
-   কি আর ভাববো। যাই।
-   কোথায় যাবে?
-   হা হা হা। কোথাও যাবো না। তোমরা যেমন কেউ ডাকলে ডাকের প্রতুত্তোরে বলো আসি। আমরা কোলকাতার মানুষেরা বলি যাই।
-   বেশ বেশ। তবে জলদি যাও। ছোঁয়া ঘটকিনি তার পার্টি নিয়ে এলেন বলে।
-   তা তোমার এত সাজগোজ কেন!
-   একটু সাঁজবো না। সবাই কি তোমার এই খুড়তুতো ভাইটাকে অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় দেখবে!
-   ব্যাপার তো নিশ্চয় কিছু একটা আছে। গতকাল তো এত সাজের বহর দেখিনি।
-   বলবো?
-   বল
-   পঁচাবে না তো?
-   আমি কি তোকে কখনো পঁচাই!
-   প্রমিজ।
-   আরে বল না বাবা।
-   তোমার হবু বউয়ের সাথে তার ছোট বোন আসবে। সে হেব্বি সুন্দরী। সাজছিলাম। যাতে আমার দিকে তার সুনজর পড়ে।
-   ওরে বাবা। এই কথা।

আজকে সাড়ে সাতটা বেজে গেলেও ঘটকিনীর দেখা নেই। প্রিয় কাকা বার দুয়েক সদর দরজার সামনে থেকে ঘুরে এলেন। আটটা বাজতে আট মিনিট বাকী এমন সময়ে পার্টি নিয়ে ছোঁয়া ঘটকিনী হাজির। তিলক একটু হতাশ হলো। যার মন কাড়তে এত তোড় জোড় সেই আসেনি। কি এক স্পোর্টিং ক্লাবের মেম্বার সে। খুলনা শহরে কাল প্রোগ্রাম আছে বলে আজকেই চলে গেছে। মেয়ের সাথে এসেছে মা, বাবা এবং মেয়ের মাসী। মেয়ের মাসীকে সুবিধাজনক মনে হলো না। মোটা গলায় কথা বললে গমগম করে। শুভর দিকে তাকিয়ে বললো, এখানে এসে বসো। তাতেই শুভর বুকটা কেঁপে উঠলো। শুভ পাশের ফাঁকা চেয়ারে বসলো গিয়ে। গতানুগতিক প্রশ্ন উত্তর। শুভ আড়চোখে লক্ষ্য করলো। আজকের এরা বেশ হাসিখুশী। মেয়েটা তো তিলকের সাথে কি একটা বিষয় নিয়ে গল্প করছে আর মিটমিট হাসছে। হঠাৎ মেয়ের মা বললো, আমাদের মনে হয় মেয়ে আর ছেলেকে আলাদা কথা বলতে দেয়া উচিত। নিজেরাই নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিক।

শুশীলাও সম্মতি জানালেন। মনে মনে ভয় পেলেন। যে হাফ ম্যাড ছেলে তার। লজ্জায় কি না কি বলে ফেলে। মুখে মেকি হাসি ফুঁটিয়ে বললেন, ওরা না  হয় এখানে কথা বলুক আমরা পাশের ঘরে গিয়ে বসি।

তিলক আরেক কাঠি সরেস। সে বললো। এখানে মনে হচ্ছে এদের অস্বস্তি লাগছে। আমার ঘরে নিয়ে বসাই।
ছোটকা বললেন সেই ভালো। যাও বাবা ওদেরকে তোমাদের ঘরে নিয়ে যাও।
তিলক দুজনকে ঘরে ঢুকিয়ে বললো, নাও তোমরা কথা বলো। আমার সামনেই বলতে পারতে। কিন্তু আমি তোমাদের প্রাইভেসী দিচ্ছি। প্রয়োজন হলে ডাক দিয়ো। ধারে কাছেই থাকবো। ভয় নেই। আড়ি পাতবো না জানালায়।

শুভ পারলে তিলকের হাত খানা শক্ত মুঠিতে ধরে রাখে। তিলক ইচ্ছে করে হাত ছাড়িয়ে বাইরে চলে গেলো। মেয়েটা চেয়ার টেনে বসলো। শুভ খাটের উপর বসে আছে। হঠাৎ পা দুখানার দিকে নজর যেতে মনে হলো তার পা দুখানা খুবই জঘন্য। পায়ের উপর অনেক রাগ হলো। মেয়েটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সেই প্রথমে কথা বললো।
-   কেমন আছেন।
-   ভালো আছি।
-   কেউ ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলে তাকেও কুশল জিজ্ঞেস করতে হয়।
-   স্যরি। কেমন আছেন?
-   ভালো আছি।
-   নার্ভাস লাগছে।
শুভ মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়।
-   আমারও বেশ আনইজি লাগছে। আগেও দুটো ছেলে দেখেছি। তবে তাদের সাথে দেখা হয়েছিলো রেস্টুরেন্টে। এরকম সপরিবারে এসে দেখা হয়নি। ভেবেছিলাম অনেক কথা বলবো।
-   নাম কি আপনার?
-   শুভ।
-   স্যরি। শুনতে পাইনি।
-   শুভ সেনগুপ্ত।
-   আরে ভাই এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে। আজকালকার দিনের ছেলেরা এত লজ্জা পায় নাকি আবার। ছেলেরাও এখন মেয়েদের সাথে সমানে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তোমার কারো সাথে রিলেশান টিলেশান নেইতো। বাবা মায়ের চাপে বিয়ে করতে রাজী হতে হচ্ছে নাতো?
-   নাহ।
-   আমাকে বলতে পারো। কোন সমস্যা নেই। আমার দিক থেকে আমি ম্যানেজ করবো। তোমাকে আর অনিচ্ছায় আমার সাথে বিয়ে বসতে হবে না।
-   নাহ আমার এরকম কেউ নেই।
-   যাক বাবা। শেষমেষ দেখা যাবে বিয়ের পরে অনেক অনর্থ হবে।

মেয়েটা অনেকক্ষণ একাই কথা বললো। শুভ মাঝে মাঝে ঘাড় নেড়ে সম্মতি দেয়া ছাড়া কিছুই করতে পারলো না। কোথা থেকে একরাশ লজ্জা এসে ভর করলো কাঁধের উপর। চোখদুটো ফ্লোরের সৌন্দর্য্য ভূলে মেয়েটার চেহারার দিকে তাকানোর ফুরসত করে উঠতে পারলো না।

এরা আসলো দেরী করে। যেতেও সময় নিলো। রাতে শুয়ে শুয়ে তিলক বললো,
-   এখানে তোমার বিয়ে হলে আমি খুশী।
-   তুমি তো খুশী হবেই।
-   আরে সেজন্য না।
-   তবে কিজন্য।
-   দেখলে না এরা মানুষগুলো খুব ভালো। খুব বেশী প্যাঁচগোঁজ নেই।
-   বাইরে থেকে কি আর মানুষ চেনা যায়।
-   ধ্যুর। তুমি অতি সন্দেহ প্রবণ। এদের সবাই ভালো। আমি তোমাকে সার্টিফিকেট লিখে দিতে পারি। একমাত্র মাসীটা ছাড়া।
-   কেন মাসী কি করলেন? ভদ্রমহাশয়া একটু রাগী বলে মনে হলো।
-   শুধু রাগী হলে কথা ছিলো। খুব খুঁতখুতে। তোমরা যখন কথা বলছিলে তখন আমি ওদের দুবোনের কথা আড়ি পেতে শুনে এসেছি। এই মাসী মেয়ের মাকে বলে আরে ছেলে তো দেখতে ফর্সা মনে হচ্ছে। পমেডম মাখিয়ে ফর্সা করেনিতো। মেয়ের মা বললো, তাই বলে তুমি কি ওকে গোছল করিয়ে আসল গায়ের রঙ দেখবে নাকি। মাসী ঠাস করে বললো, সে যাই বলো দিদি। এরা যদি কোন কিছু লুকাই তবে আমি কিন্তু একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়বো। তখন তুমি বাঁধা দিতে পারবে না। কি বড় ঘরের সাথে সমন্ধ এনেছিলাম। ছেলের লেখাপড়া কম বলে তুমি বেঁকে বসলে। আরে ছেলেদের লেখাপড়া দিয়ে কি হবে শুনি। রাঁধতে গাইতে পারলেই হলো। আধুনিকতার ধোঁয়া তুলে কি যে সব হচ্ছো না তোমরা।
-   ওকে। অনেক বকবক হয়েছে। এবার ঘুমিয়ে পড়।
-   গুডনাইট দাদা।
-   গুডনাইট।

 (লেখক ধারাবাহিক ভাবে উপন্যাসটি লিখছেন। কাহিনী এখনো চলমান। পরবর্তী পর্বসমূহ আমরা এখানে যোগ করবো।)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?