প্রজন্ম - একলা পথিক

জামান আহমেদ। বয়স পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই। বয়সে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলেও নজরকাড়া শারীরিক গড়ন, সুস্বাস্থ্য ও সুঠাম দেহের পাশাপাশি তার যুগোপযোগী ফ্যাশন সচেতনতা এবং অত্যন্ত স্মার্টনেসের কাছে পঁচিশ বছরের টগবগে কোন যুবকও তার নিকট অনায়াসে হার মেনে যাবে। তিনি একটা বেসরকারি ব্যাংকের উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। আচরণে বেশ ভদ্রমার্জিত হলেও স্বভাবে কিন্তু কিছুটা বদমেজাজি। তবে সেটা অবশ্যই সবসময় নয়।


সময়বিশেষে আর চোখের সামনে কোন অনিয়ম দেখলে তবেই। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন জামান সাহেবের গৃহকর্তা এবং অফিসের বড়কর্তা হিসাবে ভালো নামডাক থাকলেও হালকা বদমেজাজের কারণে সাধারণত অফিসের সহকর্মীরা ওপরিবারের লোকজন তাঁকে বেশ সমীহ করে চলেন। তবে তার সেই আচরণ কখনোই উগ্রতার পর্যায়ে চলে যায় না।  

জামান সাহেবের একটাই দুর্বলতা আর সেটা হলো তার একমাত্র সন্তান রাইয়ান। রাইয়ান একুশ বছরের সুদর্শন এক যুবক। দেখতে চেহারায় অনেকটা বাবার মতই। আর হ্যান্ডসাম, রুচিশীল এবং বেশ স্মার্ট তো বটেই। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। জামান সাহেবের কাছে পৃথিবীর সবকিছু একদিকে আর রাইয়ান একদিকে। রাইয়ানের জন্য এমনকিছু নেই যা তিনি করতে অপ্রস্তুত। প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসেন তিনি রাইয়ানকে। সকালে ঘুম থেকে উঠে অফিস যাবার আগমুহূর্ত পর্যন্ত আর বাসায় ফিরে ঘুমুতে যাবার সময় পূর্বপর্যন্ত রাইয়ানকে সে একনিমিষের জন্যও চোখের আড়াল করতে দিতে চান না। আর মাঝখানের সময়টুকুতে কতশত বার যে রাইয়ানের সাথে ফোনে কথা বলবেন তার কোন ইয়ত্তাই নাই।

শুধুমাত্র ছেলেকে দেখভাল করার জন্যই রাইয়ানের জন্মের পর তিনি স্ত্রী জিনিয়া আহমেদের কলেজের চাকরিটা জোরপূর্বক ইস্তফা দিতে বাধ্য করিয়েছিলেন। রাইয়ানের মা জিনিয়া আহমেদ পেশায় এখন পুরোদস্তুর একজন পাক্কা গৃহিণী। সন্তানের প্রতি এতোটা হৃদয়বান হলেও সন্তানকে শাসনের প্রতি জামান সাহেব কখনোই কোন আপোষ করেননি। আদর ও শাসন সমান্তরালে চলেছে বিঁধায় রাইয়ান বাবাকে যতটা ভালোবাসে ঠিক ততটা ভয় পায় ও শ্রদ্ধা করে। সবসময়ই সে তার বাবার কথার বাধ্য ও অনুগত সন্তান। আর শুধু রাইয়ানই নয়, জিনিয়া আহমেদও জামান সাহেবকে কিছুটা ভয় পান এবং সমীহ করেন, সংসার জীবনে আজ অবধি তিনি কখনোই তার সাথে মুখোমুখি কোনপ্রকার তর্কবিতর্কে জড়ান নাই।

একেঅপরের মধ্যে মজবুত মানসিক ও শারীরিক বোঝাপড়ার পরেও তাদের দুজনের মধ্যে কোথায় যেন কীসের একটু ঘাটতি ও অপূর্ণতা রয়েই গেছে যেটা আজো জিনিয়া আহমেদের কাছে এক অজানা রহস্য। মাঝেমাঝে তার ভেতোরে এমনসব দ্বিধাদন্দের অবতারণা হয় যে, তিনি মনেমনে ভাবেন সে হয়ত জামান সাহেবকে এখনো ভালো করে বুঝে উঠতে পারেন নি। আর নিজ থেকে সাহস করে কখনো সেটা জানতেও চান নি কোনদিন যে, কি সেই রহস্য যা তার স্বামীর ভেতোরে বিদ্যমান কিন্তু তিনি সেইটা অনুধাবন করতে পারেন না কিংবা তিনি বুঝতে দিতে চান না। আজ জামান সাহেব অফিস থেকে বেশ রাত করে বাসায় ফিরেছেন। তিনি মাঝে মধ্যেই এমন দেরি করে বাসায় ফেরেন। আগে সপ্তাহে ১/২ দিন দেরি করে ফিরলেও ইদানীং তার দেরি করে বাসায় ফেরার মাত্রাটা যেন বেশ বেড়েছে। আর তিনি যেইদিন এমন দেরিতে বাসায় আসেন ঠিক সেইদিনই তার মেজাজ বেশ চড়া থাকে। তার কথাবার্তায় আর আচরণে সেইটা স্পষ্টতই বোঝা যায়। দেখা যায় যেকোন তুচ্ছ কারণেই গেটম্যান, ড্রাইভার থেকে শুরু করে ঘরের কাজের লোকের সাথে পর্যন্ত উত্তেজিত বাক্য বিনিময় করেন। অবশ্য সকালসন্ধ্যা একনাগাড়ে একঘেয়েমিকর্মব্যস্ত থাকা ও ক্লান্তিকর কাজকর্ম করলে কারই বা মনমেজাজ স্বাভাবিক থাকে। এমন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করলেদিনের শেষে সবার মেজাজই কিছুটা তিরিক্ষি স্বভাবের হয়। তাই জিনিয়া আহমেদ জামান সাহেবের এমন আচরণকে কখনোই গভীরভাবে আমলে নেন না। রাতে বাসায় ফেরার পর জামান সাহেবের সবচেয়ে প্রিয় কাজ হচ্ছে রাইয়ানের সাথে বসে একই সাথে ডিনারকরা। বাসায় আসতে তা সে যত রাতই হোক না কেন রাইয়ানের সাথে গল্প করতে করতে ডিনার না করে তিনি কোনদিন ঘুমিয়েছেন কিনা সেটা সম্ভবত ক্যালেন্ডার ঘেঁটে বের করাও দুষ্কর। অন্যান্য সময় সাধারণত বাবা খাবার টেবিলে বসামাত্রই রাইয়ান এসে উপস্থিত হয়। এমনকি কোনদিন তাঁকে ডেকে পর্যন্ত আনতে হয় নি কিন্তু আজ রাইয়ানের যেন দেখাই মিলছে না। খাবার টেবিলে বসে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর তিনি জিনিয়া আহমেদের কাছে জানতে চাইলেন রাইয়ানের কি হয়েছে, সে কেন এখনো খেতে আসছে না। শরীর খারাপ করেনি তো আবার। জিনিয়া আহমেদ জানালেন, রাইয়ানের নাকি মাথা ব্যথা করছে আর শরীর ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, খেতে ইচ্ছে করছে না। তাই আজ বাবাকে একা একাই খেয়ে নিতে বললো। আর সে নাকি এখনি ঘুমিয়ে যাবে। রাইয়ান সম্পর্কিত জিনিয়া আহমদের মুখ নিঃসৃত বাণী জামান আহমেদকে কিছুটা চিন্তায় ফেলে দিলো। তিনি অতিমাত্রায় তটস্থ হয়ে জানতে চাইলেন কোনদিন তো এমন হয়নি কিন্তু আজ হুট করে এমন কি এমন হলো যার জন্য সে খেতে পর্যন্ত আসছে না। নিশ্চয়ই ভীষণ অসুস্থ বোধ করছে। তাই তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে স্ত্রীকে আবারো রাইয়ানকে ডাকতে পাঠালেন। 

এ যাত্রায়ও জিনিয়া আহমেদ রাইয়ান কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে বিমর্ষচিত্তে কিছুটা রাগান্বিত কণ্ঠে তাঁকে জানালেন যে, আজ রাতে রাইয়ান খাবেই না বলে ঠিক করেছে, তার নাকি ভালো লাগছে না, সে ঘুমিয়ে গেছে। স্ত্রীর চোখেমুখে রাগান্বিতভাব দেখে তিনি বুঝতে পারলেন নিশ্চয়ই রাইয়ান তার মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে। হঠাৎ রাইয়ানেরএমন অস্বাভাবিক আচরণে জামান সাহেবের ভেতোরে বেশ রাগ ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করতে লাগলো। শরীর একটু অসুস্থবোধহলেও এখানে এসে অন্তত কিছুটা সময়তো বাবার সাথে গল্প করতেই পারতো কিংবা বাবাকে গুডনাইটজানিয়ে যেতেপারতো।কিন্তু তাই বলে তার মায়ের সাথে এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ জামান সাহেবকে ভীষণ উত্তেজিত করলো। তিনি তৎক্ষণাৎ জিনিয়া আহমেদের কাছে জানতে চাইলেন--- _ আজ রাইয়ান এমন করছে কেন? কি হয়েছে ওর? শরীর খুব বেশি খারাপ করেনি তো আবার ? ~ আমিও বুঝতেছি না। শরীর তো খারাপ হবার কথা নয়। হঠাৎ কি এমন হলো ওর। _ ভার্সিটিতে কোন সমস্যা হয় নাই তো আবার, জিজ্ঞাসা করেছিলে সেটা? আজকে ভার্সিটি থেকে রাইয়ান কখন বাসায় ফিরেছে ? ~ ভার্সিটিতে সমস্যা হবে কেন। আজ তো রাইয়ান ভার্সিটিতেই যায় নি। সারাদিন বাসাতেই ছিল। আজ বাসাতে ওর একটা ভার্সিটি ফ্রেন্ড এসেছিল, গ্রুপ স্টাডির জন্য। সারাদিন ওরা দুইজন ওর রুমের ভেতোরেই ছিল, কোথাও বের হয় নি। _ বল কি ? কে এসেছিল বাসায়? কোন ফ্রেন্ড, কেমন ফ্রেন্ড নাম কি তার, কি করে, কোথায় থাকে, কেন এসেছিল? (উত্তেজিত হয়ে প্রশ্নগুলো করলেন জামান সাহেব) ~ আরে ওর ফ্রেন্ডকে আমি চিনবো কীভাবে? আগে কখনো দেখিনি আজকেই প্রথম দেখলাম। তাছাড়া আমার সাথে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেয় নাই তাই তার সম্পর্কে জানা হয়নি। শুধু বলল যে ভার্সিটির জরুরি একটা অ্যাসাইনমেন্টের কাজে নাকি সে এসেছিল । _ ও আচ্ছা! তাহলে দুপুরে ফোনে রাইয়ান আমাকে বলল যে ও ভার্সিটিতে আছে। আমাকে মিথ্যা বলল কেন? আগে তো কখনো মিথ্যা বলেনি? আগে থেকে বললেই পারতো যে বাসাতে ওর একটা ফ্রেন্ড আসবে? কেন জানায়নি আমাকে ?


 ~ হয়ত ভয়ে তোমাকে আগে থেকে জানায়নি পাছে তুমি আবার রাগ করো যদি তাই। আচ্ছা তুমি এতো উত্তেজিত হচ্ছ কেন? এতোটা উত্তেজিত হবার কি আছে। এখন ছেলে বড় হয়েছে তার ফ্রেন্ডরা বাসাতে আসতেই পারে। এটা নিয়ে এমন আহামরি ভাবনাচিন্তার কি হল,কিছুই বুঝতেছি না ? _ একদম চুপ করো। মোটেও বেশি বোঝার চেষ্টা করো না। এতোটা ভাবনার কি হল সেটা কি আমার তোমার কাছে জবাবদিহি করতে হবে, নির্বোধ মহিলা কোথাকার। যা জানতে চাইছি সাফসাফ তার উত্তর দাও। (বেশ ধমকের সুরে কথাগুলো জামান সাহেব জিনিয়া আহমেদকে বললেন) জামান সাহেবের ধমক খেয়ে জিনিয়া আহমেদ কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে চলে গেলেন। আর জামান সাহেব ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে রাইয়ানের কক্ষের দরজার সামনে দাড়িয়ে তাঁকে বার কয়েক ডাকতে গিয়েও আবার বিরত হলেন। ভাবলেন সে হয়ত খুব বেশি ক্লান্ত তাই আর তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে চাইলেন না। খানিকক্ষণ চুপ করে একই জায়গায় দাড়িয়ে থেকে অবশেষে ব্যালকোনির দোলনা চেয়ারে বসে আকাশের অর্ধ গোলাকার চাঁদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে লাগলেন। নানান ধরণের বাজে আর দুশ্চিন্তাগুলো তাঁকে যেন চারপাশ থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরতে লাগলো। কেন রাইয়ান তাঁকে মিথ্যা বলল? কেমন ফ্রেন্ড আজ বাসায় এসেছিল যার জন্য তাঁকে মিথ্যার শরণাপন্ন হতে হলো? সেই ফ্রেন্ডের সাথে ওর কি ধরণের সম্পর্ক আর ভার্সিটির বন্ধু হলে সেটা বাবাকে বলতে সমস্যা কোথায়? কেন সারাদিন রুমের ভেতোরেই থাকলো? তাহলে রাইয়ানও কি... ? এইসব নানাবিধ প্রশ্নবোধক চিন্তাগুলো জামান সাহেবকে যেন অক্টোপাসের মত জড়িয়ে ধরতে লাগলো। আবার কিছুক্ষণ বাদেই মনেমনে আনন্দিত হয়ে মুচকি হেসে তিনি ভাবতে লাগলেন ধুর আমি এইগুলো কীসব উল্টাপাল্টা চিন্তা করছি। রাইয়ানকে নিয়ে আজেবাজে নোংরা সন্দেহ করছি। আমার রাইয়ান এমন হতেই পারে না। আমি আমার রাইয়ানকে খুব ভালো করেই চিনি। ওর প্রতিটা নিঃশ্বাস আমার বুকে গিয়ে লাগে। ওর ভেতোরে আমি আমার প্রাণ খুঁজে পাই। আমার অস্তিত্ব আমি ওর মাঝেই অনুভব করি। আমি আমার রাইয়ানকে অনেক অনেক ভালোবাসি আর ওর উপরে আমার অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস আছে। আমার বিশ্বাস এতো ঠুনকো হতে পারে না। আমার প্রজন্ম অবশ্যই এমন হতে পারে না। ঘটনাটা পরের দিনের......... 


একটা জরুরী অফিসিয়াল মিটিং বাতিল হওয়ায় পরদিন সন্ধ্যায় জামান সাহেব অনেক আগেভাগেই অফিস থেকে বাসায় চলে এলেন। অ্যাপার্টমেন্টের পার্কিং লটে গাড়িটা পার্ক করে লিফটের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মিনিট কয়েকপরে লিফটের দরজা খুলতেই তিনি যা দেখলেন তার জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। এমন বিব্রত ও ভীতিকর কোন পরিস্থিতিতে তিনি কখনো পড়তে পারেন সেটা তার কল্পানারও বাইরে ছিল। সামনের দৃশ্যমান কাউকে দেখে জামান সাহেবকে একরাশ ভয় আর আতংক যেন গ্রাস করতে চাইছে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার ভেতোরেও তার কপাল গড়িয়ে ঘাম ঝরতে লাগলো। তিনি কিছুতেই যেন স্বাভাবিক হতে পারছিলেন না। কারণ লিফটের দরজা খুলতেই তিনি দেখতে পেলেন লিফটের ভেতোরে যাকে দেখতে পেলেন সে আর কেউ নয়, স্বয়ং সাফাত দাড়িয়ে। জামান সাহেব যাকে যৌনসঙ্গী হিসাবে ভাড়া করে নিয়ে মাত্রই দুইদিন আগের এক সন্ধ্যায় অভিজাত একটা হোটেলের বিলাসবহুল কামরায়যৌন অভিলাষ করেছিলেন। তিনি প্রায়ই অফিস শেষ করে সন্ধ্যার দিকে রাজধানীর অভিজাত কোন হোটেলে গিয়ে কোমলমতি ছেলেদের সাথে এমন কামলীলায় মত্ত হন। এটা তার বহুত পুরনো একটা অভ্যাস। আর তাই প্রায়ই তার বাসায় ফিরতে রাত হয় এবং ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরে সবার সাথে বদমেজাজি স্বভাব প্রদর্শন করেন যেন সবাই বুঝতে পারেন তিনি অফিসে অনেক পরিশ্রম করে এসেছেন। তাই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সাফাতকে দেখে তিনি একেবারে চমকে গেলেন। গোপন ও অবৈধ শারীরিক লালসার কোন সঙ্গী যখন আপন আলয়ের একদম সন্নিকটে চলে আসে তখন সে পৃথিবীর যত বড় বীরপুরুষই হোক না কেন, ভয় ও আতংক সে পাবেই এইটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তাই জামান সাহেবের অবস্থাও ঠিক তেমনই হলো, তিনি যেন একদম কোন ঘোরের ভেতোরে আছে তার কাছে এমন ঠেকতে লাগলো। সাফাতকে স্বচক্ষে সেখানে দেখে সে যেন একদম নির্বাক কাঠের পুতুল বনে গেলো। যেন সদ্য দাঁড়ান এক জীবন্ত লাশ মাটিতে লুটিয়ে পড়ার নিমিত্ত মাত্র। সাফাতও জামান সাহেবকে দ্বিতীয়বার দেখতে পেয়ে ভীষণ বিস্মিত হলো। সে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিল না। জামান সাহেব নিজেকে রহস্যের ঘোর থেকে বাস্তবতায় নামাল যখন সাফাত তার কাছে জানতে চাইলো, : আরে মিস্টার তুমি এখানে যে, আমিতো ভাবতেও পারছি না, তোমার সাথে আবার এভাবে দেখা হবে। কি এখানে কোন নতুন মাল পাইছো বোধহয়? হা হা হা... সাফাতের এমন কথায় জামান সাহেব বেশ লজ্জিত ও বিব্রত হয়ে নিজের ঠিকানা গোপন করে মৃদু কণ্ঠে তাঁকে জানালো যে, এক আত্মীয়ের বাসাতে একটা পারিবারিক অনুষ্ঠানে হাজির হতে এখানে এসেছেন। 

পরক্ষণেই তিনি সাফাতের কাছে জানতে চাইলো সে এখানে কেন এসেছে। প্রতিউত্তরে সাফাত যা বলল সেইটা যেন জামান সাহেবের মস্তিষ্কে বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটার ন্যায় আঘাত করলো। এমন কোন কথা নিজ কানে কখনো তাঁকে শ্রবণ করতে হবে সেইটা সে জীবনেও ভাবতে পারেনি। তার কাছে মনে হতে লাগলো মৃত্যুর যন্ত্রণাও বোধহয় এমন ভয়ংকর বাণী হজম করার চেয়েও ভীষণ আরামদায়ক। সাফাত কথাগুলো বলছিল আর তার অনুভব হতে লাগলো কে যেন তার পিঠে সজোরে চাবুক পেটাচ্ছিল। আসলে সাফাত তাঁকে যা জানালো তা ছিল এমন, “দক্ষিণ ইউনিটের বি-ব্লকের নাইন-সি নম্বর ফ্ল্যাটের রাইয়ান নামের এক যুবক নাকি তাঁকে প্রায়ই দিনচুক্তি ভাড়া করে তার ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে। পোলাটা দেখতেও নাকি সেইরকম একখান মাল। সে নাকি জামান সাহেবের চেয়েও হেব্বি সেক্সি আর ক্রেজি। সেইরকম সাইজ যা তার চেয়েও ঢের বড়। অনেক মজা দিতে জানে। একদিনে ৪/৫ বার লাগাইতে পারে”। জামান সাহেব লিফটের ভেতোরে একা দাড়িয়ে আছেন। সাফাতের শেষ কথাগুলো জামান সাহেবের কর্ণকুহরে যেন বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো। নোংরা অশ্রাব্য বাণীগুলো সাগরের ঢেউয়ের মত ক্রমাগত তার হৃদয় তীরে আছড়ে পড়তে লাগলো। পুরো পৃথিবীটা যেন তাঁকে কেন্দ্র করে লাটিমের ন্যায় ভনভন করে ঘুরছে। পায়ের তলার সমতল জায়গা তাঁকে রেখে কেমন যেন দূরে সরে যেতে চাইছে। নিজের ওরসজাত সন্তান সম্পর্কে পৃথিবীরআর কোন বাবা এমন অকথ্য ভাষা শুনেছে কিনা সেটা ভেবেই তার দুচোখ গড়িয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো। নিজের ভেতোরে লালন করে চলা দ্বিতীয়সত্তা যে এভাবে তার রক্ত দিয়ে প্রবাহিত হয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে চলবেসেটা অনুমান করতেই বুকভাঙা কষ্টে চিৎকার করে কেঁদে ফেললো। সৃষ্টিকর্তা তার মত এমন অসহায় পিতা যেন আর কাউকে না করেন সেইজন্য হাতজোড় করে তার দরবারে প্রার্থনা করতে লাগলেন এবং তার নিজের ভেতোরে ধারন করা অস্তিত্বে আর কোন পরবর্তী প্রজন্ম যেন প্রভাবিত না হয় তার পরিত্রাণ কামনা করতে লাগলেন।

১২টি মন্তব্য:

  1. লেখক বাইসেক্সুয়াল দের একটি অন্তর্নিহিত দুর্বল পয়েন্টে আঘাত করার চেষ্টা করেছেন এবং দু:খজনক হলেও সত্যি যে, আঘাত করতে তিনি অত্যন্ত ভালোভাবেই সক্ষম হয়েছেন। অনেক সুন্দর হয়েছে গল্পটা।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. বাইসেক্সুয়ালরা হচ্ছে সব থেকে নির্যাতিত শ্রেণী। এরা না পারে কইতে আর না পারে সইতে।

      মুছুন
    2. Thanks a lot u both of two..

      মুছুন
    3. এই কি সেই নামহীন মন্তব্যটা ?

      মুছুন
    4. না এটা না, এর পরেরটা হল সেই নামহীন মন্তব্য। পইড়াও বুঝেন না মিয়া ভাই!!! শেম শেম

      মুছুন
  2. আমার প্রিয় গল্পকারদের একজন একলা পথিক। ছোট গল্পের সব কটি বৈশিষ্ট্য ফুঁটে উঠেছে প্রজন্ম গল্পটিতে। লেখকের জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. এহেম এহেম ... ধন্যবাদ ভাইয়া...

      মুছুন
    2. নাম ব্যবহার করলে মনে হয় আমার প্রতি ধন্যবাদ দিতে সহজ হতো লেখক সাহেব।

      মুছুন
  3. হোমোসেক্সুয়াল পিতার পুত্ররা আদৌ হোমোসেক্সুয়াল হবে কিনা এটার কোন সায়েন্টিফিক যুক্তি নাই।গল্পটা নিছক ভাল হয়েছে,তবে বিজ্ঞানভিত্তিক হয়নি। বাইসেক্সুয়ালদেরকে অহেতুক হ্যারাসমেন্ট করা হয়েছে। একাকী পথিক আমারো প্রিয় লেখক।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. একাকী পথিক না... একলা পথিক... হুহ

      মুছুন
    2. গল্প কি বিজ্ঞানভিত্তিক হয়? সাই ফাই গল্প/সিনেমাও কি আজগুবি কাহিনীতে ঠাসা থাকে।

      মুছুন

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?