হৃদ মাঝারে রাখবো - মনতোষ দে

ক্লাস থেকে বের হয়ে একটু চিন্তায় পরলাম। পকেটে মাত্র একশ টাকা। সম্বল বলতে এটুকুই। কাল নীলের জন্মদিন। তিন বছর ধরে একসাথে আছি। ছেলেটাকে কখনোই কিছু দেয়া হয়নি। পৃথীবিতে কিছু কিছু মানুষ আছে যারা অল্পতেই খুশী। নীলও তাই। ও এমন একটা ছেলে যার কাছে কিছুই লুকানো যায়না। আর তাই তিন বছরের মধ্যে ওর সামনে কখনো মন খারাপ করতে পারিনি। এমনিতেই ও অনেক বেশি কেয়ারিং।

নীলের সাথে আমার পরিচয় কলেজে । স্কুল থেকে বের হয়ে প্রথমেই নিজেকে গুছিয়ে নিতে কিছু সময় লাগে। জীবনের বড় একটা অংশ ভালোবাসার কাছ থেকে দূরে থাকার ফলে ছেলেদের প্রতি তীব্র কৌতূহল ছিল। যদিও ছেলে হিসেবে আমি বেশ লাজুক প্রকৃতির। একবার কলেজের এর সামনে বসে ফুচকা খাওয়ার পর টাকা দিতে গেলে খেয়াল করলাম পকেটে মানিব্যাগ নেই। এক প্রকার অস্বস্তির মধ্যে পড়লাম। ছোটবেলা থেকেই আত্মসম্মান বোধটা আমার প্রচন্ড। ফুচকাওয়ালাকে বললাম 'কাকা , মানিব্যাগ ফেলে এসেছি। আমার কাছে টাকা নাই। এই ঘড়িটা রাখুন।' দোকানী বিজয়ীর হাসি দিল। স্টিভ জবস আইপড আবিস্কার করে যেমন হাসি দিয়েছিলেন অনেকটা সেরকম। জীবনের সেই চরম অপমানজনক অবস্থা থেকে নীলই আমাকে রক্ষা করেছিল। সেই থেকে একসাথে আছি। জীবনের বাকীটা পথও এভাবেই থাকার ইচ্ছা।
মনে মনে একটা হিসেব দাঁড় করালাম। কাল নীলের একুশতম জন্মদিন। থানা মোর থেকে একুশটা লাল গোলাপ কিনতে হবে। আর সাথে নীলের সবচেয়ে পছন্দের কৃষ্ণপক্ষ বইটা। সবমিলিয়ে দেড়শ টাকার মধ্যে হয়ে যাওয়ার কথা। বিকেলে অবশ্য হাতে কিছু টাকা আসবে। প্রথম আলোর সাহিত্য পাতায় গত সপ্তাহে আমার একটা লেখা ছাপা হয়েছিল। তার সম্মানী হিসেবে কিছু পাওয়ার কথা। আসলে বালুরঘাট শহরে অর্থের কষ্টটা কাউকে বুঝতে দেয়া যায়না। প্রিয় মানুষ গুলোকে তো না ই। আর নীল যদি জানতে পারে আমার এ অবস্থা তা হলে নির্ঘাত খুন করে ফেলবে। হাতে এক হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বলবে 'ধুর গাধা। ফ্রেন্ডদের কাছে কিছু লুকোতে হয়?' গত তিনবছরে অনেকবার এমন হয়েছে। যদিও নীল আমার শুধু বন্ধুই না, বন্ধুর চেয়ে কিছুটা ওপরে। তবে আমার ইচ্ছে কাল ওকে আমার ভালোবাসার কথা বলবো।
আগে থেকেই প্লান করা। সকালে ও স্যারের কাছে পড়তে আসবে। সেখান থেকে দু জন বেড়িয়ে যাবো। নীলের সাথে ঘোরার একটা আলাদা মজা আছে। সারাক্ষন পাগলামী করবে। কখনো চুল ধরে,কখনো শার্ট ধরে টান মারবে। আর সবসময় হাসির কথাবার্তা। দামী কোন রেস্তোরায় খেতে গেলে বলবে 'ধুর বোকা,তুই কি অনেক টাকা আয় করিস? তার চেয়ে আয় বাদাম খাই। শোন বাদাম হলো ভালোবাসার ফল। দেখিস না খোসার মধ্যে দু টো ফল। একটা তুই আর একটা আমি। আর আবরন হয়ে আছে ভালোবাসা কিংবা বন্ধুত্ব। বলেই জোড়ে হাসত। বালুরঘাট শহরের আকাশ বাতাস কাঁপানো সে হাসি দেখে মনে হত এই মানুষটার কোন দুঃখ নেই। থাকতে পারেনা।
বিকেলে প্রথম আলোর সাহিত্য পাতার অফিসে গেলাম। যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অল্প কিছু টাকা বেশি পাওয়া গেলো। হলে ফেরার পথে একুশটা সাদা গোলাপই কিনলাম। ইচ্ছে ছিল লাল গোলাপ কিনবো। কিন্তু নীল এখনো আমার বন্ধু। লাল গোলাপ দেয়ার সাহস হলোনা। ফুল কেনার পর গেলাম বই মার্কেটে। অনেক খুঁজে কৃষ্ণপক্ষ বইটা কিনলাম। হাতে কিছু টাকা বেশি থাকায় একটা কবিতার বই ও কিনলাম। নীলের আবার হুমায়ুন খুব পছন্দ। মাঝেমাঝে ক্লাসের ফাঁকে ও বলত ...এই গাধা,তুই কি কিছুই লিখতে পারিসনা? দেখিস না হিমু কি সুন্দর করে লিখেছে...এ হাত ছুঁয়েছে নীরার হাত। আমি কি এ হাতে কোন পাপ করতে পারি? ইস যদি কেউ আমার হাত ধরে এভাবে বলত. . . .দেখতাম নীলের অভিমানী চোখ দুটো ছলছল করে উঠতো। আমার খুব ইচ্ছে হত নীলের হাত ধরে বলি 'আমি আর কখনো পাপ করবোনা নীল, তোর হাত টা একটু ধরতে দিবি???
গত চৌদ্দই ফেব্রুয়ারীর কথা। খুব সকালে নীলের ফোন। ঘুম জড়ানো কন্ঠে মোবাইল রিসিভ করে বললাম 'কি রে, তুই এত সকালে? ওপাশ থেকে নীল শাসনের সুরে বললো 'আমি কলাভবনের সামনে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে চলে আয়। আমি স্বভাবতই একটু ঢিলেঢালা। নীল জানতো আমার আসতে আধঘন্টা লাগবে। তবুও অসহায় ছেলেটি আমার পথের দিকে তাকিয়ে থাকতো। কিছুক্ষন পর এসে দেখি নীল দাঁড়িয়ে আছে। নীল শার্ট পরা নীলকে দেখে মনে হল এক টুকরো আকাশ আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মুগ্ধ চোখে নীলের দিকে তাকিয়ে বললাম 'তুই আসলেই অনেক সুন্দর...'
নীল অভিমানের স্বরে বললো 'তুই আসলেই গাধা, এতো দিনে খেয়াল করলি? শুধু আমার মনের ভেতর কোথাও বেজে উঠতো ...ভালোবাসি তোমাকে. . ."
আজ অনেক দিন পরে আমরা আবার একটু বেরবো ...।। সকাল থেকেই নীলের জন্যে অপেক্ষা। কখনো ও এত দেরী করেনা। মনের মাঝে অজানা আশঙ্কা কাজ করছে। আজ আবার হরতাল। কখন কি হয় বলা যায়না। আজ অনুধাবন করলাম অপেক্ষার কষ্ট আসলেই অনেক। প্রতিবারই নীলকে যা আমার জন্যে সহ্য করতে হয়। এসব ভাবতে ভাবতে সামনে আগালাম। গোলাগুলির শব্দ। নীলের মোবাইলে ফোন দিলাম। অনেক আওয়াজের মধ্যে অপরিচিত একটা কন্ঠ বলল 'একটা ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছে,অভিযাত্রীর মোড়ে আসেন। আমি অবাক বাকরুদ্ধ হয়ে উদভ্রান্তের মত ছুটলাম। ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে দেখি নীল। মাটিতে লুটিয়ে আছে। ফিনকি দিয়ে পরা রক্তের অজস্র ধারায় নীল শার্ট খানা খয়েরী হয়ে গেছে।. . . .
সবুজের ডাকে তন্দ্রা ভাঙলো। এই ওঠ বারোটা বাজে। নীলকে Wish করবিনা? হঠাত্ করেই নিজেকে আলাদা এক জগতে আবিস্কার করলাম। কি দুঃস্বপ্নটাই না দেখেছি। এক মুহুর্ত দেরী না করে নীলকে ফোন দিলাম। এক রিং হতেই নীল ফোন ধরল। 'কি ব্যাপার হাঁপাচ্ছিস ক্যানো?কি হয়েছে?????"
আমি বললাম 'নীল আমি তোকে অনেক অনেক ভালোবাসি।আমাকে ছেড়ে যাবিনাতো. . . .?'
নীল বললো কি পাগলের মত কথা বলছিস,কি হয়েছে বলবিতো? আমি বললাম "শোন কাল তোর আসতে হবেনা। দেশের অবস্থা ভালো না। কাল হরতাল...'
নীল অবাক হয়ে বলল ক্যানো?
মুখ থেকে মনের অজান্তেই বের হয়ে গেল 'আমি তোকে হারাতে চাইনা.
নীল আমার নীরবতায় কন্ঠ জোরালো করে বলল, কি রে চুপচাপ আসিস কেন?
নীলের ধমকে আমার বোধ ফিরে এল, ভাবলাম একি বলছি আমি।
যে দিনটার জন্য আমি এতদিন অপেক্ষা করেছি, হূদ মাঝারে যত্নে রাখা প্রিয় মানুষটাকে বিশেষ দিনে পাশে পাব না তা কি করে হয়।
ভাবনা শেষ না হতেই নীল চট করে বলল, ফোনটা কাট তো, আমি নিজেই তোর কাছে আসছি।নীলের কথাটা আমাকে পুরো হতবাক করে দিল।ফোনটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসে রইলাম কতগুলো প্রশ্ন সাথে যুদ্ধের জন্য।যে নীল আমাকে এত ভাল বন্ধু ভাবে তাকে কিভাবে বলব, সে আমার ভালবাসা। না বলব না তাকে। এভাবেই আড়াল থেকে তাকে ভালবাসব আমি। হূদ মাঝারে রাখব জাড়িয়ে বন্ধুত্বের দাবি দিয়ে আজীবন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?