শিরোনাম বিহীন ভালোবাসার গল্প - জিতু আহমেদ

শুরুটা কিভাবে করব বুঝতে পারছিনা। যা বলব তা হয়ত বেমানান। হয়ত এতে আমার ভালবাসা প্রশ্নবিদ্ধ হবে চতুর্দিক থেকে। এটা একটা বেনামী সম্পর্কের কাহিনী। যাতে ভালবাসা আছে, বন্ধুত্ব আছে, দাবী আছে, অধিকার আছে, কিন্তু কোন নাম নেই। 

আমি অর্ণব। এখন একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করি। ঘটনাটা আমার ভার্সিটি লাইফের। তখন আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র। প্রাণচঞ্চল যুবা। পড়াশুনা, গান, থিয়েটার, বন্ধু আর আড্ডা। এই আমার দুনিয়া। সমপ্রেমি হিসেবে ফেসবুকে নাম লিখিয়েছিলাম বছর দুয়েক আগে। শুরুতে বেশ আবেগী ছিলাম। একা তো। তাই কেউ একটু ভালভাবে কথা বললে অল্পতেই তাকে খুব আপন বলে মনে হত। ফেসবুক থেকে একটা সম্পর্কেও জড়িয়ে ছিলাম তখন। কিন্তু মাস খানেক পরেই তা ভেঙ্গে যায়। খুব বিষণ্ণতায় ছিলাম তখন। আমার সরল মনটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয় গিয়েছিল। তারপর থেকে এসব ফেসবুকীয় সম্পর্কে আর বিশ্বাস ছিলনা আমার। সবার সাথে শুধু ফ্লার্ট করে বেড়িয়েছি সেই থেকে। তবে মানুষ তো বদলায় একদিন। আর সেটা নিজেকে দেখেই জেনেছি। সময় আর পরিস্থিতি আমাকে এক সময় আবেগহীন করে তুলেছিল। তবে মানুষ যতই আবেগহীন হোক না কেন, সত্যিকারের ভালবাসা বা মধুর সম্পর্কের কাছে সে হার মানবেই। হতে পারে তা ভালবাসার সম্পর্ক বা বন্ধুত্বের। মোটকথা যে সম্পর্ক গুলা মানুষকে সুখী করতে পারে, মানুষ চিরকাল সেই সম্পর্কের ছায়াতলেই বাচতে চায়।

ভার্চুয়াল জগতে আমার অনেক বন্ধু। একাকীত্বকে ঘোচাতে এর চেয়ে ভাল বন্ধু আর কিছুই নেই। সেদিন সকালে ফেসবুকে ঢুকেই একটা স্ট্যাটাস দিলাম। তারপর আরও বন্ধু বাড়ানোর জন্য যেইনা কতগুলো ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছি, অমনি ফেসবুক আমায় জানাল আমাকে ব্লক করা হয়েছে। আর এটা খুলতে কিছু ছবির পরিচয় দিতে হবে। মেজাজটাই গরম হয়ে গেল আমার। ঘণ্টা খানেক চেষ্টা করার পরেও সফল হলাম না। খুব খারাপ লাগছিল। কারণ এই একাউন্ট থেকে অনেক কিছু পেয়েছি। কিছু ভাল মানুষ, কিছু ভাল ভাই-বন্ধু। কিন্তু একাউন্টটা হারালে সব হারাব আমি। এই জগতের মানুষ খুব সহজেই সবাইকে আপন করে নিতে পারে। টি এতগুলো আপনজন হারানোর দুঃখ এবং ভয় দুটোই আমার বেশি। 

মন খারাপ নিয়েই ভার্সিটিতে গেলাম। ফিরে এসে আবারো ট্রাই করতে লাগলাম। আর কাকতালীয় ভাবে এবারের চেষ্টায়ই সফল হলাম। শেষ পর্যন্ত একাউন্টটা উদ্ধার করতে পেরেছি। ফটো ভ্যারিফিকেশন করার সময় এক মায়াভরা মুখ আমার নজর কাড়ল। আর আমার গল্পের শুরুটা এখান থেকেই। 

ছবর মুখখানা বেশ মায়া ভরা গম্ভীরতা নিয়ে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। মুখটা খুব চেনা চেনা লাগছিল। কোথায় যেন দেখেছি, মনে পড়ছে না। ফ্রেন্ড-লিস্ট ঘেঁটে দেখলাম ছেলেটা আমার আইডিতে এড হয়েছে আরো ৯ মাস আগে। কিন্তু কখনো হাই, হ্যালো বলা হয়নি। ছেলেটাকে নক করলাম।
-hi
-Hello
-তুমিতো আমার জন্য লাকি। তোমার ছবিটা ভ্যারিফাই করেই আইডিটা ফেরত পেলাম। 
-ওহ তাই! যাই হোক আমার সাথে ফ্লার্ট করে লাভ নাই। আমি বুকড!
-আরে না না। ফ্লার্ট করিনি। তোমার সাথে কখনো কথা হয়নি তো তাই। 

কথায় কথায় জানলাম তার নাম জেন... অনার্স থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। পড়ে চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটিতে। একজনের সাথে তার সম্পর্ক আছে। আর তাকে সে অনেক ভালবাসে। প্রথম দিনেই মন খুলে কথা বলল ছেলেটা। প্রথম দিনে তার শেষ কথা ছিল “তুমি খুব ভাল মানুষ। এমনই থেক।” সত্যি খুব ভাল লাগছিল আমার। ওই শেষ কথার রেষ যেন কান থেকে ফুরাচ্ছিলই না আমার। 

সময় যেতে থাকল। প্রতিদিন নিয়ম করে আমাদের কথা হত। অল্প সময়েই খুব ভাল বন্ধু হয়ে গেলাম আমরা। আমার খজ খবর, তার প্রতিদিনের কাজ কর্ম, তার সম্পর্ক। এই গুলো নিয়েই বেশি কথা হত। ধীরে ধীরে তুমি থেকে তুই হলাম আমরা। বেশ চলছিল আমাদের। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হত। যদিও তাকে সামনা সামনি দেখিনি কিন্তু মনে হত তাকে আমি বেশ অনেক দিন ধরেই চিনি। একটা অন্য রকম টান অনুভব করতাম।

বন্ধু, হ্যাঁ সে আমার খুব ভাল বন্ধু। মাঝে মাঝে আমরা জান, জানু এসব মজা করে ডাকাডাকি করতাম। একে অপরকে I Love You বলেছি অনেকবার। কারণ বন্ধুত্বের তো সীমা নেই কোন। আর সেটা যে পুরোপুরি মজা করেই বলা তা দুজনেই জানি। কিন্তু নিছক তামাশা হলেও কথা গুলো মন থেকেই বলতাম। বুঝতে দেইনি কখনো তা। জেনকে ধীরে ধীরে অবচেতন মনেই ভালবেসে ফেলেছি আমি। কিন্তু এটা কেন আর কিভাবে হল বুঝলাম না। জেন তো অন্য কাউকে ভালবাসে। আমি নিজেই নিজেকে এমন ভাবার জন্য দায়ী করলাম। আর জেনকে এড়িয়ে যেতে থাকলাম। কিন্তু দেখলাম এতে হিতে বিপরীত হচ্ছে। ওর প্রতি টানটা আরো বেড়ে যাচ্ছে আমার। তবে মুখ ফুটে আমার মনের কথা জানালে নির্ঘাত জেনকে হারাবো। তার চেয়ে চুপচাপ থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। এর মাঝে একদিন জেন আমায় বলল,
-আচ্ছা অর্ণব, আমার মনে হয় আমি তোকে ভালবেসে ফেলেছি।
-তাই নাকি! এতো সৌভাগ্য আমার!
-আরে... Be serious…
-হহাহাহা... শোন, ওটা মনে মোহ ছাড়া আর কিছুই না। 
-কি জানি। হলেই ভাল। কিন্তু কেন জানি মনে হয় তোকে আমি ভালবেসে ফেলেছি। আচ্ছা আমার বিএফ কে কি আমি আর আগের মত ভালবাসি না? বাসলে তো আর তোকে আমার ভাল লাগত না। 
-উফ! জেন, বললাম না এটা তোর ভালোলাগা। ভাল লাগতেই পারে কাউকে। It’s not a big deal. কিছুদিন পর আপনা আপনিই ঠিক হয়ে যাবে। 

এদিকে জেনের মন থেকে মোহ সরাতে গিয়ে আমি ভাবলাম, একটা সম্পর্কে জড়ানো উচিত আমার। নিজের নিয়ম ভেঙ্গে একজনের সাথে সম্পর্ক করলাম। কিন্তু পারিনি তাকে জেনের মত করে ভালবাসতে। সবাই বলে প্রথম ভালবাসা সবচেয়ে আলাদা। তবে আমার মনে হয় সত্যিকারের ভালবাসাই সবচেয়ে আলাদা। আর সেটা জীবনের ৭ নাম্বার ভালবাসাও হতে পারে। কি কারণে জেনকে ভালবাসি জানিনা। শুধু জানি ভালবাসি। আমার নতুন সম্পর্কের কথাটা ইচ্ছে করেই লুকিয়ে রেখেছিলাম।

এভাবে আরো কয়েক মাস কেটে গেল। এর মাঝে জেন জানালো তার বিএফের সাথে নাকি ইদানীং খুব বোঝাপড়ার সমস্যা হয়। এটা শুনে মনে মনে বেজায় খুশি হলাম আমি। এবার ভাবলাম, এতে আমার কি? আমিও তো এখন একজনের সাথে সম্পর্কে আছি। আমার মনকে আমি নিজেই বুঝিনা। কখন যে কি চায়। এত উরু মনের মানুষদের প্রেম সম্পর্কে না জড়ানোই ভাল। সেদিন রাতে জেনের সাথে চ্যাট হল অনেকক্ষণ। কখন যে ঘুমিয়ে গেছি টের পাইনি। হঠাৎ ফোনে চোখ বুলাতেই দেখলাম, জেনের ৯টা মিসড কল। তাড়াতাড়ি কল ব্যাক করলাম। রিং বাজতে না বাজতেই রিসিভ করে জেন বলল,
-কিরে থাকিস কই তুই? ফোন ধরিস না কেন?
-ফোনটা সাইলেন্ট ছিল তাই। 
-জানিস আমি কাল রাতেই ঢাকা আসছি। 
-সত্যি! কই আগে তো বললি না এ কথা।
-তাতে কি, এইতো এখন বললাম। যাই হোক তোর ঠিকানা দে আমি দেখা করব।
-আরে ঢাকা ভার্সিটির হলে আসতে ঠিকানা লাগে নাকি?
-হাহাহা... ওকে আমি বিকেলের ভার্সিটিতে গিয়ে তোকে ফোন করব। 
-ঠিক আছে।

আজ জেনের সাথে দেখা হবে ভাবতেই আমার দারুণ লাগছে। বিকেল ৪টা ১৫তে জেনের কল পেলাম। ও কার্জন হলের সামনে দাড়িয়ে। তড়িঘড়ি করে ছুটে গিয়ে দেখা করলাম। সামনা সামনি ওকে দেখে কি করব বুঝতে পারছিলাম না। কথায় কথায় জানলাম ও এখানে ওর খালাতো বোনের বিয়েতে এসেছে। থাকবে কিছুদিন ঢাকায়। সেদিন অনেক গল্প গুজব করলাম আমরা। তারপর প্রতিদিন প্রায় ৪ ঘণ্টার মত একসাথে ঘুরে ফিরে সময় কাটাতাম। পুরো ঢাকা চষে বেড়িয়েছি দুজনে। যাওয়ার আগের দিন, মানে শেষের দিন ও খুব আবেগ নিয়ে কথা বলছিল। আমার ভালও লাগছিল, আবার অস্বস্তিও লাগছিল। কারণ আমাদের দুজনেরই বিশেষ কেউ আছে। আর তার পরেও এগুলো ভাবা অন্যায়। দুজনে ধানমন্ডি লেকে দাঁড়িয়ে গোধূলি উপভোগ করছিলাম। জেন এমন সময় আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, -অর্ণব I Love you. 
আমি হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললাম, -এটা বলিস না। তোর বিএফ শুনলে তোকে কিন্তু ছাড়বেনা।
-সে আর নেই রে...
-নেই মানে? কি হয়েছে জেন? সব ঠিক আছে তো?
-কিচ্ছু ঠিক নেই। আমাদের ব্রেকাপ হয়ে গেছে। 
-কিন্তু কেন? 
-আমি জানিনা। হুট করে একদিন আমায় বলল আমাকে আর তার ভাল লাগেনা। সে আর আমার সাথে থাকতে চায়না।
-ওটুকু পিচ্চি তোকে এত বড় কথা বলল আর তুই দাড়িয়ে দাড়িয়ে শুনলি?
-আসলে একটা সময় তো তাকে ভালবাসতাম, তাই তার অসম্মান করি কিভাবে? আর কেন জানি আমাদের সম্পর্কে আমিও খুশি ছিলাম না। তোকে দেখার পর থেকে অনেক বুঝিয়েছি নিজেকে যে এটা হবার নয়। কিন্তু এই মন মানেনি। i love you. I really love u…
-জেন তোকে আমিও অনেক ভালবাসি। এটা হয়ত বলতাম, কিন্তু সে অধিকার আমার নেই। আমি এই মুহুর্তে কারো সাথে সম্পর্কে আছি। আমি চাইলেও তোর ভালবাসা আর নিতে পারব না। 
-হয়ত এই ছিল নিয়তি! তবে তোকে আমি অনেক ভালবাসি আর বাসবো। কতটা ভালবাসি তোকে তা বলে বোঝাতে পারবনা। 
-আমার দুর্ভাগ্য জেন, আমি দুহাতে ওটা মাখতে পারলাম না।
-ধুর বোকা দুর্ভাগ্য বলছিস কেন? তোকে পাই বা না পাই, আমি জীবনের শেষ দিন অব্দি তোকে ভালবাসবো। জানিস অর্ণব? শুনেছি আমাদের সমপ্রেমিদের শেষ দিনগুলো নাকি একলা একার। আমার সেই একলা দিনগুলোর সাথী হয়ে সেদিন থাকবি তুই পাশে? বন্ধুই থাকি আমরা। তথাকথিত প্রেমিক যুগল নাহয় নাইবা হলাম আমরা। ভাল বন্ধু হব শেষ দিনগুলোর।

আমি কিছু বলতে পারছিলাম না, চোখ দিয়ে পানি পরছিল। কেউ কাউকে কতটা ভালবাসলে এমন ভাবে বলতে পারে। সত্যি আফসোস লাগছিল জেনকে মনের মত করে না পেয়ে। কিন্তু কি আর করব? কারো সম্পর্কের সুতোয় যে বাধা পরেছি আমি। তাকে কষ্ট দিয়ে জেনের কাছে যেতে আমার বিবেক, আমার মনুষ্যত্ব বাধা দিচ্ছে আমায়। তাই আমি চাইলেও আমার হাত পা বাধা। তবে জেনের কথাই থাক। আমরা বন্ধু, প্রানের বন্ধু। যাদের দুটি দেহ একটি আত্মা। দুজনে ভালবাসি দুজনকে। কিন্তু প্রকাশ করবনা। মনে মনে দুজন দুজনের হাত ধরে চলে গেছি অনেক দূরে। কিন্তু কেউ কাউকে টের পেতে দেইনি। এতটা ভালবাসা আমাদের। সব জমা রাখছি ওই বুড়ো বয়সের দিনগুলোর জন্য। যখন দুজন দুজনের চামড়া ভাজ পড়া হাতে হাত রাখব। এই বুড়ো এই বুড়ো দুজন দুজনকে ডাকবো। কেউ কারো কাঁধে চড়ে ঘুরে বেরাতে পারবনা। কিন্তু কাঁধে হাত রেখে হাঁটতে পারব। সেদিনের জন্য আমাদের সব ভালবাসা। 

কি আজব আমার প্রেমের গল্প তাইনা? ফেসবুকে ফটো ভ্যারিফাই করতে গিয়ে জেনকে দেখলাম। যখন মনে মনে তাকে ভালবাসতাম তখন সে অন্য কারো... আর যখন প্রকাশ্যে সে তার ভালবাসার ঝুলি আমাকে দিল, তখন আমার দুহাত বাধা... নিয়তি আমাদের নিয়ে অদ্ভুত এক খেলা খেলেছিল। আর সেই থেকেই ওই খেলার পুতুল হয়ে আছি আমরা... জানিনা আমার আর জেনের ভবিষ্যৎ কি... যৌবনে তো অনেক প্রেম পায় মানুষ। আমার প্রেমটা থাকনা তোলা জীবনের শেষ দিন গুলোর জন্য... আপাতত এ সম্পর্কের কোন নাম দিতে পারলাম না। তবে টিকে থাক এই সম্পর্ক। আমাদের এই বেনামী সম্পর্ক...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?