পীরিতির সাতকাহন - উইন্ডি স্ট্রম

কখনো তো গুছিয়ে হিসেব করে দেখি নি, এ জীবনে কত অসংখ্য সুদর্শন, সুপুরুষকে দেখে মুগ্ধতায়-বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি, কত দিনের পর দিন রাতের পর রাত তাদের নিয়ে স্বপ্নে হারিয়েছি, কল্পনার নকশীকাঁথা বুনেছি সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে। সেই ছোটবেলা থেকেই আমার প্রেমে পড়া শুরু। যতদূর মনে পরে, আমার আট-ন’বছর বয়েসে বলিউড নায়ক ঋত্বিক রোশানকে দেখেই আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছিলাম। “এত সুন্দর মানুষ হয় কি করে!!!”- সারাদিন  শুধু ওকেই ভাবতাম, আর একটু সুযোগ পেলেই ওকে দেখতাম। ওসব অনেককাল আগের কথা। ওসব গল্প বাদ থাকুক। আজকে বরং বড়বেলার গল্প বলি। কৈশোরের-যৌবনের, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের গল্প। 

গল্পের শুরু অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কিছুদিন আগে থেকেই। উচ্চমাধ্যমিকের পর, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য যখন কোচিং করা শুরু করি তখনই প্রথম মনে হলো, “কোচিংযের ভাইয়াগুলো কি অসম্ভব সুন্দর! শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে!” খুব বেশি ভাইয়াকে তো চিনতাম না, তবে কয়েকজন ছিলো যাদের দিকে ক্লাসের পুরোটা সময় হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। তবে তখনো তো আর জানতাম না, আমার জন্য সোনার খনি অপেক্ষা করছে। কপালচক্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর হল-এ উঠে প্রথম যাকে রুমমেট হিসেবে পাই, তিনি আমার চেয়ে বছর চারেক-এর বড় ছিলেন। কি অসম্ভব সুন্দর মানুষ বলে মনে হয়েছিলো তখন তাকে! সুঠামদেহী, গৌরবর্ণ, কোঁকড়ানো চুলের চব্বিশ-পঁচিশ বয়েসের যুবক আমাকে মুগ্ধ করেছিলেন তার সবটুকো অস্তিত্ব দিয়ে। কপালদোষে বেশিদিন ঐ রুমমেটকে কাছে পাই নি, অন্য রুমে চলে গেছিলাম র‌্যাগ খাওয়ার ভয়ে। র‌্যাগ অবশ্য তিনি দিতেন না, দিতো ঐরুমের আশেপাশে থাকা বদগুলো। তিনি বরং আমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিলেন। তারপরও রাস্তায় দেখা হলেই মিষ্টি হেসে কুশল বিনিময় করতেন, খোঁজ নিতেন পড়াশোনার। আমিও মিষ্টি হেসে “ভাইয়া, ভাইয়া” ডাকের তুফান ছুটাতাম। তিনি তো আর জানতেন না, আমার মনে কি আছে! 



যাই হোক, একজন গেলো তাতে কি, চারপাশে খানিক চোখ বুলিয়ে, মন খেলিয়ে আমি দেখলাম , এ তো পুরোই স্বর্গরাজ্য!!! এমন অসম্ভব সুন্দর চেহারাধারী, ব্যাক্তিত্ববান সব পুরুষকুল আমার ঘরের আশেপাশে বসত গেড়েছে। নতুন রুমের তিন বছরের সিনিয়রটিও ছিলেন একেবারে দেবদুর্লভ কান্তিধারী! ইনিও বেশ লম্বা, খাঁড়া নাক, মিষ্টি হাসি, স্বল্পভাষী। খুব খাতির জমাতে চেষ্টা করেছিলাম সেই পাশের বিছানায় শোওয়া সুদর্শনের সাথে। জমেও গেছিলো। কিন্তু ব্যাটা ডেস্টিনির সদস্য, আমাকে খালি পয়সার গল্প শুনাতো। বুঝতে পেরেছিলাম আমাকেও দলে টানতে চাইছে, কিন্তু মুখ ফুটে কখনো বলে নি। তাছাড়া আমার এত পছন্দের যুবাপুরুষটি একদিন কথায় কথায় আমাকে ‘হাফ-লেডিস” ডেকে বসে। খুব খেপে কথা বলা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছিলাম। করবো নাই বা কেন? মানলাম আমি মেয়েলি, মানলাম লোকে হাফলেডিস বলে খেপায়। তাই বলে এ ও? প্রেম ছুটে গেলো অল্পতেই। আসলে তো আর অত সহজে ছুটে না। কথা না হয় বেশি বলতাম না, কিন্তু মন তো ঠিকই পোড়াতো। একদিন তার কোন একটা  গল্পের বইয়ে একটা মেয়ের নাম দেখে কেমন যেনো বুক চিনচিন করে উঠেছিলো। যেনো সে শুধুই আমার সম্পত্তি, অন্য কারো নাম তার অস্তিত্বের কোথাও থাকবে না। আমার আবার চিরায়ত বঙ্গরমণীদের মতো বদস্বভাব, বুক ফাঁটে তবু মুখ ফুটে না। তাই আর কখনোই খুব বেশি কথা বলি নি ভাইয়ার সাথে, বরং আশেপাশের অন্য ফুটন্ত যৌবনধারীর দিকে নজ্র বুলাতে ব্যাস্ত ছিলাম। ওহ!! বাথরুমের পাশের রুমগুলো ছিলো HOT ভাইয়াদের আখড়া। একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখেছি, HOT ছেলেরা পরস্পরের বন্ধু হয়। হয়তো আলাদাভাবে দু’টো বা তিনটে ছেলেকে আমি পছন্দ করে রেখেছি, তাদেরকে আমি আলাদা আলাদা জায়গায় দেখে চিনেছি, হয়তো বা অন্য হল-এ, কিংবা ক্যাম্পাসে, বা ক্যান্টিনে। কিন্তু হায় ভগবান! একদিন হঠাৎ দেখি ওগুলো একসাথে হেসে বেড়াচ্ছে বা হেঁটে বেড়াচ্ছে, পরে জানতে পারি ওরা জিগরি দোস্ত। এমন অভিজ্ঞতা অনেক হয়েছে। এই যেমন এখন, বেশ কয়েকটা কিউটি কিউটি, হটি-নটি সুপুরুষ জুনিয়র ছেলেকে আমার পছন্দ। ওমা ! একদিন দেখি কি , ওগুলো সব একই ব্যাচের, এবং যথারীতি ভালো বন্ধু। 

মাঝে মাঝে ভাবি, যদি কখনো কোন ছেলের সাথে আমার প্রেম হয়, তাহলে তার বন্ধুদের দেখেও কি আমি মজে যাবো!! তওবা! তওবা!! কিন্তু হয়ে গেলে আমিই বা কি করতে পারবো? আমিও তো একটা মানুষ, না কি? হাহ, এমন সোনাবাঁধানো কপাল নিয়ে কি আর আমি জন্মেছি? আমার দেখে দেখেই জীবন পার করতে হবে। যাক গে ওসব। আরো কতো ব্যাচমেট, সিনিয়র, জুনিয়রের প্রেমে যে মজেছি, লিখতে গেলে মহাকাব্য না হোক, মহাগপপো হয়ে যাবে। হাসিব ভাইয়া, বিত্ত ভাইয়া, রৌপ্য ভাইয়া, রাকিব স্যার, আরো কত!! সবার নামধামও তো জানি না। ইশশ!! কি সুন্দর সব মানুষগুলো! রাকিব স্যারকে দেখলেই তো আমার ঝাঁপিয়ে পড়ে গালে, কপালে, নাকে ঠোঁটে পাগলের মতো চুমু খেতে ইচ্ছে করে। কি যে কষ্ট হয় স্যার-এর ক্লাসে!! স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বুঝবো কি, স্যারের পাতলা ঠোঁটের আধো হসিমাখা নিরীহ-শান্ত চেহারাটা দেখে উথালি-পাথালি কল্পনায় হারিয়ে গিয়েই পুরো একটা ঘন্টা কেটে যায়। এক ঘন্টায় কি সব শেষ হয়ে যায় না কি? স্যারকে নিয়ে মনে মনে কতো দিন সুখের সংসার পেতেছি, হানিমুনে গেছি এখানে-ওখানে, স্যার খুব আদর করে পড়া বুঝিয়ে দিয়েছে। 

আহ! প্রিয় সুখ-কল্পনারা! কখনো কি তোমাদের বাস্তবে আসতে নেই? তাসনীম ভাইয়া বা রৌপ্য ভাইয়া দু’জনের ক্ষেত্রেই প্রেমে মজেছিলাম তাদের প্রেমিকা আছে একথা জানার পড়েও। পড়তে দোষটাই বা কি? প্রেমিকা না থাকলেই কি তারা আমার সাথে উদ্দাম প্রেম শুরু করতেন না কি? তা কি এ জন্মে সম্ভব! কি বিষণ্ণ-মিষ্টি চেহারা ছিলো তাদের! আসলেই কি বিষন্ন ছিলো? কি জানি। আমি ভেবে নিতাম, ওরা এই প্রেমে সুখী নয়, খুব কষ্টে আছে। শুধুমাত্র আমার ভালোবাসাই পারে ওদের সব দুঃখ মুছে দিতে। হাসি পাচ্ছে এসব কথা শুনে? পেলে পাক। কল্পনা!! কি ভীষণ সুখের সব কল্পনা!! গোটা জীবনটাই কাটিয়ে দিলাম কল্পনায় ডুবে থেকে। আরো কতো অসংখ্যা প্রেমকল্পনা ছিলো আমার। অনেকগুলো তো ভুলেও গেছি। আজকে এই পর্যন্তই থাক, আরেকদিন বাকি সব বলবো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?