দ্বৈরথ - বকুল আহমেদ

১।
আমি জানি আমাকে একটা খুন করতে হবে। শীঘ্রই। খুব শীঘ্রই।
এ চিন্তায় আমার ঘুম প্রায় হারাম হওয়ার যোগাড়।
গত রাতে ১০টায় শুয়েছি।এখন তিনটা বেজে গেল এখনো ঘুমোতে পারলাম না। তাবাসসুম বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। হাল্কা নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। আমি উঠে পানি খেলাম। তাবাসসুমকে দুইবার হাল্কা করে ধাক্কা দিলাম। সে উমমম জাতীয় একটা আওয়াজ দিয়ে আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়ল।
অথচ এই পরিকল্পনায় সেও কি পরোক্ষভাবে অংশিদার নয়?

ভাবতে ভাবতে হাল্কা মত তন্দ্রা মনে এসে গেল।
আমার মনে হলো আমি যেন এক উত্তাল সমুদ্রের পাশে দাঁড়িয়ে! ঝড়ো বাতাস। ঝড় বিধ্বস্ত সিন্দাবাদের মত পড়ে আছি নির্জন সৈকতে। আমার সামনে এক বিরাট গুহা দেখতে পেলাম। গুহায় একটা দরজা দেখা যায়। ভিতরে ঢুকতেই রিনরিনে কন্ঠের এক কিশোর বলে উঠলো, “তুমি এতদিনে এলে?”

সেই কন্ঠ ছাপিয়ে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যেতে লাগল।আমার মাথায় সে ঝিঁঝিঁর শব্দ বেড়েই চললো।আমি বলতে চাইলাম কিছু কিন্ত ঝিঁঝিঁ জন্য পারলাম না। ঘুম ভেঙ্গে গেল। বুঝলাম ওটা ঝিঁঝিঁ নয়। আমার সাইলেন্ট মোডে থাকা মোবাইলের শব্দ। প্রিয়মের ফোন। বিরক্তিতে মন বিষিয়ে উঠলো। এখন কি ফোন করার সময়? কেটে দিলাম। মন খারাপ করবে হয়তো। ওর মন খারাপ হলে আগে আমারো খারাপ হতো। এখন যেটা হয় তার নাম বিতৃষ্ণা।

বাহিরে বেশ ঝড়ের মত। আর জানালা খোলা। প্রথম রাতের গুমোট ভাবটা আর নেই। স্বপ্নে দেখা উথাল বাতাসের ব্যপারটা পরিষ্কার হলো। পিপাসা পেয়েছে। পানি খেয়ে এসে কয়টা বাজে চেক করতে দেখি মেসেজ এসেছে। প্রিয়মের। “খুব খারাপ লাগছে। মিসিং ইউ”। সাড়ে চারটা বেজে গেছে। একটু পড়েই ফজরের আজান হবে। নামাজে প্রথম কাতারে দাঁড়াতে হবে। আব্বা এ ব্যপারে খুব কড়া।
বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিলাম। মুখটা তেতো লাগছে। আরে আমারে তোর এই মধ্য রাতে মিস করার কি আছে! আমি কি তোর ভাতার! কয়েকবার তোর সাথে রংগরস করছি বইলা কি আমি তোর গোলাম হইয়া গেছি না তুই আমার গেলমান!
“তোমার কি হইছে? ঘুমাও না কেন!”

তাবাসসুমের স্বরে কুয়াশা কাটা রোদের মমতা। গোলগাল আদুরে গোলাপী ফরসা মুখ।
“ঘুমায়ে পড়। এত কি চিন্তা!”


২।
উপরের অংশটুকু আমার কল্পনা।
আমি এখন যে ট্যাক্সিতে চড়ে আছি তার চালকের আত্মকাহিনীর প্রথম অংশের। সিডনী শহরের একট নামকরা গে ক্লাব থেকে বাসাতে যাওয়ার সময় তার ট্যাক্সিতে চড়েছিলাম।কেন এবং কি প্রসঙ্গে সে তার জীবন কাহিনী বলা শুরু করল তা এই মূলগল্পের সাথে অপ্রাসঙ্গিক বিধায় এড়িয়ে গেলাম।
মূলগল্পে ফিরে যাই। আমি বললাম,
-   কেন তোমার কোন চিন্তা নেই?

-   ভাই আসলেই বাহিরের চোখে আমার এত কি চিন্তা! বংশ পরম্পরায় আমরা যে খানকা শরীফের উত্তরসূরী তার বেশ নাম ডাক। পীরাতির সহীহ ত্বরিকা ছাড়াও আমার আব্বা –ভাইজানের আমল আখলাকের, মহিলাদের পরদা-পুশিদার অনেক সুনাম আছে এই দেশে। এ জন্য আমাদের মুরীদ কিংবা অনুগ্রহ প্রার্থীর কখনো অভাব হয় নি। অভাব নেই অর্থ বিত্তের। বাহিরের দিক দিয়া চিন্তা করলে আসলেই তো আমার কি চিন্তা ! কিন্তু ভেতরতা কি কেউ দেখল না! ভাগ্যিস আল্লাহ পাক ভেতরটা কাউরে দেখার সুযোগ দেয় নাই...।দেখলে এই মুরিদকূল , আব্বা-ভাইজান, আম্মিজান সবাই কি আগেই আমারে বিষ খাওয়ায় মাইরা ফেলত না।
এরপর ট্যাক্সিচালক আরসালান(!) যা বললো তা এরকমঃ

“যৌন বোধ নিয়ে এই দ্বিধা আমি অনেক আগেই টের পেয়েছিলাম। এজন্য প্রায়ই ঊদাস থাকতাম। খানকার সুপুরুষ খাদেম, মুরীদ দেখলে বুকটা টনটন করত যেমন করত সুন্দরী জেনানাদের দেখলে।
পীরজাদা হওয়া সত্ত্বেও আব্বাজান আমাকে আধুনিক লাইনে পড়াশোনা করিয়েছেন। একটা নামকরা প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে গ্রাজুয়াশন করি। সেই সীমিত স্বাধীনতার সময় কয়েকজনের সাথে আমার শারিরীক সম্পর্ক হয়েছে। আব্বা কি কিছু আঁচ করতে পেরেছিলেন? তাই তিনি দ্রুত তাবাসসুমের সাথে আমার শাদী দিয়ে দেন। আমিও ভালো (!)হয়ে যাওয়ার নিয়ত করে শাদী করে ফেলি। বাবা হয়ে যাই বছর না ঘুরতেই । ভালোই চলছিল। যতদিন না প্রিয়ম জীবনে আসে।

সে এসেছিল তার মা এর সাথে। তার মা এর দিককার আত্মীয়স্বজন আমাদের দরবার শরীফের বংশপরম্প্রায় মুরীদ। প্রিয়মের সমস্যা হল সে দুইবার সুইসাইড করতে গিয়েছিল। কেন কেউ জানে না। বাসার সবাই পেরেশান। তার নাকি ঘুম হয় না। ঘুম হলেও উল্টা-পাল্টা স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে সে এক বরফ ঢাকা সাগরে ডুবে যাচ্ছে। যেখানেই মাথা তুলতে চায় সেখানেই বরফ।ঘুমের মধ্যেই তার অক্সিজেন ফুরিয়ে আসে। শ্বাস নিতে পারে না। তাই তার মা তাকে এই খানে নিয়ে আসে। তার নাকি খুব গোপন কিছু জিগ্যাসা আছে!

আব্বাজান আর ভাইজান তখন সফরে ছিলেন। কাজেই আমিই পীরজাদা হিসেবে তখন খানকার কিছু ব্যাপার দেখভাল করতাম। বিষয়টা আপাতঃ বেশি জটিল না হওয়ায় আমি তার সাথে বসলাম নিজস্ব ঘরে। সেই সময় তাকে পুরোপুরি দেখলাম। কথা-বলা চোখ, টিকোলো নাক, ইশারাশ্রয়ী পাতলা গোলাপী ঠোট... কি অপরূপ কান্তিই না তার মুখাবয়বে! কি সে বলতে চায় জানতে চাইলে, সে আমাকে কিছুটা অবাক করে জানাল সে সমকামী। জানালো এ পৃথিবীতে তার করূণ অস্তিত্বের কথা। ব্যর্থ প্রেম আর অসামাজিক মূল্যবোধের কথা। সে তার অদ্ভুত যৌন আচরন থেকে মুক্তি চায়। সে এ  ব্যাপারে অনেক পড়াশোনা করে, গবেষনা করে দেখেছে মৃত্যু ছাড়া আর মুক্তি নাই তাই সে পরিবারের সম্মান বাঁচাতে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছিল। এখন সে মুক্তি চায়। আমার কি কিছু করার আছে?
এমন আত্মস্বীকৃতি আমার জীবনে প্রথম। আমি কি আমার ভেতরটাও অনেকদিন পর দেখলাম? তাকে কিছু গতানুগতিক উপদেশ দিলাম। আয়াত ও কিসসা শুনালাম। বললাম কিছুদিন এই খানকায় থাকতে। সে কি বুঝলো- রাজী হল। তবে একটাই শর্ত – আমার সাথে সে থাকবে।
সে ধীরে ধীরে খানকার কঠিন নিয়মের সাথে মানিয়ে নিলো। নিয়ম আর পরিশ্রম যে কারনেই হোক তার স্বপ্ন দেখা বন্ধ হলো। স্বাভাবিক হাসিখুশী ভাব ফিরে এল। কিন্তু আমার বিপরীত হতে লাগলো। সংসার থেকে মন উঠে গেল। তাবাসসুম কিংবা পরিবার- বংশ মর্যাদার সীমানা ছাড়িয়ে প্রিয়মের প্রতি ভয়াবহ দুর্বল হয়ে পড়লাম। তারও সম্মতি ছিল। মুরীদদের সাথে দেখা করার নাম করে তাকে নিয়ে ঘুরতে লাগলাম দেশের আনাচে কানাচে। নির্জন কামরায় নিবিড়তম প্রেমলীলায় লিপ্ত হতাম। তার নিঃশ্বাসের সুগন্ধ, নিটোল দেহরূপ আর কাম ছন্দাবিষ্ট মদির মিলনে অনুভব করলাম যৌবন নামক নিয়ামতের সম্পূর্ণতা।
দুই অঞ্জলীতে তার চন্দ্রমুখ ধরে যখন অধরসূধা পান করতাম মনে হতো শরাবুন তহুরা পান করতেছি। ফিস ফিস করে বলতাম,”প্রিয়ম তুই তো আমার শরাবুন তহুরা রে!”
সে আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলত “আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না তো! আপনাকে হারালে আমাকেও আর কেউ খুঁজে পাবে না।”
আমি একটু চুপ থাকলে তার দুচোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো!
সেই অশ্রু আমার সিক্ত অধরে মুছে দিয়ে গভীরতম আলিঙ্গনে বেধে বলতাম,
আশিকী সে কেয়া মজা হ্যয়,
মাসুক সে পুছলো
বাগে গুল মে কেয়া মজা হ্যয়
বুলবুল ও সে পুছলো -

আহা কি সব সেই সময় গেছে!
আসলে আমরা দু’জনেই নিজ নিজ নিষিদ্ধ সীমাবদ্ধতাকে ডিঙোতে চেয়েছিলাম। তাই সে মিলনে রোমাঞ্চ ছিল- যে রোমাঞ্চ ছিল বিবি হাওয়া-আদমের গন্ধম ভক্ষনে, রাধা-কৃষ্ণের নিষিদ্ধ অভিসারে। এই রোমাঞ্চই আমাদের আপাত সম্ভোগকে বোধহয় প্রেমে পরিনত করেছিল যা আজ টের পাই! “
৩।
-তারপর...
এ সব ক্ষেত্রে যা হয় আর কি।
বিবির অভিশাপ, আম্মির কান্নাকাটি, অবুঝ শিশুর মায়া আর আব্বা-ভাইজানের শাসন, তাবিজ-কবচ-নসিহতের চাপে নতি স্বীকার করে নিলাম। গোপন একটা অপরাধবোধ ও ছিলো।
সব কিছুর জন্য আমার প্রিয়মরেই দোষী মনে হতে লাগলো। তাকে আমার অসহ্য লাগতে শুরু করলো। তাই তাকে অপমান করা শুরু করলাম। “গেলমান” বলে ডাকতাম। ফোন ধরতাম না। মেসেজ এর রিপ্লাই করতাম না। দেখা করার কথা দিয়ে দেখা করতাম না। দেখা করলেও খিস্তি খেউর করতাম। অভিশাপের সুরে কথা বলতাম। তার বেদনার্ত অবাক মুখ দেখে বিকৃত এক আনন্দ উপভোগ করতাম। শারিরীক অত্যাচার করতাম। একবার তার মাথা দেয়ালের সাথে এত জোরে ঠুকে দিয়েছিলাম যে সে কিছুক্ষনের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। আর এ সব করার সময় আমার খারাপ লাগত না, ভয়ও লাগত না। কারন আমি জানতাম আমার যৌন অবস্থানের কারনে আমি তার চেয়ে অনেক সবল।আমার সাথে আমার ধর্ম আছে, সমাজ আছে। তার দাবীর সাথে খোদা-বান্দা কেউই তো নেই। তার মৃত্যু হলে সমাজ-রাষ্ট্র কেউই আমাকে দায়ি করবে না।
এক সময় নিজের কাছেই মনে হতে লাগল তারে যদি খুন করতে পারতাম।
-   তো তাকে খুন করলেন ?
-   যেমন ব্যবহার তার সাথে করলাম তা তো একরকম খুন ই। আবার ঘুমের অষুধ খেল। কিন্ত সেবার আর হাসপাতাল থেকে ফিরে আসে নাই।

-   তারপর
-   তারপর আমিও স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। প্রিয়মের স্বপ্নগুলো। বিরাট এক ঠান্ডা বরফ ঢাকা সাগরে ডুবে যাইতেছি। যেখানেই সাগর থেকে মাথা তুলতে যাই সেখানেই বরফ। ঘুমের মধ্যেই অক্সিজেন ফুরিয়ে আসে। শ্বাস নিতে পারি না। আর সে সময় ঘেমে জেগে উঠি। ঘুম হয় না। জেগে থাকলে সবসময় খালি প্রিয়মকে দেখি। খানকার নামাজের কাতারে, জিকিরের মজলিসে, খানার কামরায়...সব জায়গায়।
-   তারপর
-   তাবিজ কবচ নিলাম। অনেক ডাক্তার দেখালাম। রোগ সারে না।কোনো উপায় না দেখে আব্বা সৌদী পাঠায়ে দিল। ওইখান থেকে লাইন ঘাট করে সবার থেকে পালিয়ে সিডনী এসে পড়েছি। এসেছি অতীত থেকে প্রিয়মের থেকে পালিয়ে থাকার জন্য। গত ৫ বছরে একবারও দেশে যাইনি। কারো সাথে যোগাযোগও করি না। দেশের সবার থেকে দূরে দূরে থাকি।
আমি আরসালান কে জিজ্ঞেস করি,

-   তুমি এখনও কি একা? আরসালান আর কথা বলে না। আমি তার ভারী হয়ে আসা নিঃশ্বাসের শব্দই শুধু শুনতে পাই। ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া দিতে গিয়ে তার দিকে আরো একবার ভালো করে তাকাই। স্ট্রীট লাইটের মৃদু আলোতে সে তার অশ্রু লুকোতে পারে না। ট্যাক্সিটা পেছনে ফেলে একটু এগোতেই পিছনে হাউমাউ করে কাঁদার শব্দ শুনতে পাই। আমি একবার ও পিছু ফিরে তাকাই না। বা সান্ত্বনা দেই না।

 কাঁদুক , সে মন ভরে কাঁদুক।

৪।

বাসা তে ফিরে খুব ক্লান্ত লাগছিল।
৬০” থ্রি ডি স্মার্ট টিভির মুভি কিংবা আমার ও তাহমিদের যুগল ছবি সে ক্লান্তি দূর করতে পারছিল না।
হঠাত মনে হল আরসালানকে তো একটা জিনিস জিজ্ঞাসা করা হয় নি- তার বউ-বাচ্চার কথা!
অনেকদিন পর আমার যূথীর কথা মনে পড়ে।
এতদিনে সে কি আমায় ক্ষমা করতে পেরেছে?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?