বরষা-কাব্য - বন্ধু বুনোফুল

সমস্ত আকাশ উপুড় হয়ে ভেঙ্গে পড়ছে।গত দুইদিন ধরে কোন বিরাম নেই।পড়ছে তো পড়ছেই।'কি এত দুঃখ আকাশের?'-বিছানায় শুয়ে ভাবছে নয়ন।চেয়ে আছে বিছানার ডানদিকের খোলা জানালার দিকে।বাতাসে বৃষ্টির ফোটাগুলো জানালা গলে বিছানায় এসে পড়ছে ওর গায়ে।ভালোই লাগছে।বৃষ্টির দুঃখ আর ওর কষ্ট যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।এই রকম এক বরষায় ওর দেখা হয়েছিল কৌশিকের।বৃষ্টির দিনে সেই দিনটার কথা মনে পড়ে যায় নয়নের।এই যেন সেদিনের কথা।নয়ন সেদিনও বসে বসে বৃষ্টি দেখছিল।সালমার মা এসে জানালো,'ছোটভাই,আপনার নতুন ছার আসছে।দরজায় খাড়ায়ে আছে।'-'দরজায় দাড় করিয়ে রেখেছ কেন?ড্রয়িং রুমে এনে বসাও।'

-'সম্ভব না।আম্মায় বকবেন।'
-'কি জ্বালা।আম্মু কেন বকবে?উনি কি বাইরে বসে পড়াবেন নাকি?'
-'সে আপনে দেখে আসেন।তয় একটা কথা বলি ভাইজান।ছারের উপর মনে কয় জ্বীনের আছর আছে।ওনার কাছে না পড়নই ভালা।'
-'দাড়াও দেখি।'বলে উঠে দাড়াল নয়ন।সালমার মাকে রাখা হয়েছে ওর দেখাশোনা করার জন্য।কিন্তু নয়নকে দেখার চাইতে ওনার টিভি দেখাতেই আগ্রহ বেশী।ওনাকে ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে নয়ন।ওনার একটা মহা ত্যাদর মেয়েও থাকে।নাম সালেহা।তবুও কেন ওনাকে সালমার মা ডাকা হয় সেটা নয়নের কাছে আজও অজানা।নীচের দরজায় নয়ন এসে দেখল একটা কালোপনা ছেলে সারাগায়ে কাঁদা-মাটি মেখে,একটা ভাঙ্গা চশমা চোখে দিয়ে জুবু-থুবু হয়ে দাড়ায়ে আছে।ওকে দেখেই একটা লাজুক হাসি দিল ।'ইয়ে মানে পড়ে গেছিলাম।'
-'ভালো কাজ করেছেন।তা ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি?ভিতরে আসেন।পরিষ্কার হোন।'
-'না মানে এক মহিলা বলল এই অবস্থায় ভিতরে গেলে নাকি আংকেল মানে আপনার বাবা পা ভেঙ্গে দেবে।তাই.........'

-'আমি বলছি কিচ্ছু হবেনা।ভিতরে আসেন।'ধপ্পাস।ভিতরে ঢুকতে গিয়ে চৌকাঠে পা বেঁধে হোঁচট খেল কৌশিক।থুতনিতে বেশ খানিকটা কেটে গেছে।চেঁচিয়ে সালমার মাকে স্যাভলন আনতে বলল নয়ন।স্যাভনল-তুলো নিয়ে গজরাতে গজরাতে আসল সালমার মা।'আগেই কইছিলাম ওনার মাথায় ছিট আছে।নিজের চোখে দেখলেন তো।'
-'বেশী কথা বোলো না তো।ওগুলো দাও দেখি।'-'ওমা আপনি রক্ত পরিষ্কার করবেন নাকি?এডিস হবে।'-'এডিস হবে!এডিস কি?'
-'ঔ যে টিভিতে দেখায় না রক্ত দিয়ে এডিস ছড়ায়।'হাসি চেপে রেখে কৌশিকের দিকে ফিরল নয়ন।ছেলেটা হতভম্ভ হয়ে হা করে আছে।এই ছেলেটা নাকি BUETএর খুব মেধাবী একজন ছাত্র!সব মেধাবীরা কি এরকম ছাগল হয়?
-'বেশী কথা বোলো নাতো।যা বলছি তাই কর।'
-'এই নেন ধরেন।পরে কিন্তু বলতে পারবেন না যে আমি আপনেরে সাবধান করিনি।'ঐদিকে কোথা থেকে সালেহা এসে হাজির।সে মহা আনন্দে চিল্লাচ্ছে,'কি মজা!কি মজা!ছোটমামাজানের এডিস হবে।আমি এডিস দেখব।'' এই মেয়েটাকে পরে কোন এক সময় একটা থাপ্পড় দিতে হবে। এখন এখনকার কাজ করি।'মনে মনে ভেবে তুলায় স্যাভলন ভিজিয়ে কৌশিকের দিকে ফিরল নয়ন।ছেলেটা এখনও হা করে আছে।

-'নিন মুখটা এবার বন্ধ করেন।'
-'আ...আমার AIDS নেই।'কোনরকমে মুখ ফুটে এইটুকুই বের হল কৌশিকের।
-'থাকলেও সমস্যা নেই।দেখি মুখটা একটু উঁচু করেন তো।'স্যাভলনের প্রথম ছোঁয়া পেয়ে একটু চমকে উঠল কৌশিক।আর নয়ন শিহরিত হল কোশিকের প্রথম স্পর্শে।অনেকবারের মধ্যে প্রথমবার।চশমার পাওয়ার জেনে পরদিনই একটা চশমা নিয়ে এলো নয়ন।সাধারনভাবেই চশমাটা নিল কৌশিক।সেই থেকে শুরু।আস্তে আস্তে দুজনের মাঝে জড়তা কাটতে লাগল।একে অপরের কাছে এলো।কখন যে দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলল তা কেউ জানেনা।কিন্তু কেউই মুখ ফুটে কিছু বলেনা।ভালোবাসার প্রকাশও হল এক বরষায়।সেদিন ঘরে বসে নয়,ছাদে দাঁড়িয়ে ভিজছিল নয়ন।হঠ্যাৎ পিছনে এসে দাঁড়াল কৌশিক।কি মনে করে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল নয়নকে।ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর মুখোমুখি হল নয়ন।কৌশিককে জড়িয়ে ধরল সেও।'ভালোবাসি............'বাকী কথাগুলো আর বলতে পারলনা কৌশিক।নয়নের ঠোঁট ওর ঠোঁটকে আকড়ে ধরেছে।ধপ্পাস।নয়নকে নিয়ে আছাড় খেল কৌশিক।



ভালোই চলছিল ওদের।বড়লোক বাবার একমাত্র সন্তান নয়ন।আর ওদিকে গ্রামের বাবা-হারা এক ছেলে কৌশিক।মায়ের কষ্টে আর নিজের মেধার জোরে এতদূর এসেছে সে।নয়নের বাবা-মায়ের সাথে কৌশিকের দেখা হল কদাচিৎ।তারা খুবই ব্যাস্ত।টাকা দিয়েই নয়নের সব ইচ্ছা-আবদার পূরণ করতে চায়।এরই মধ্যে ওদের বাসায় বেড়াতে এলেন নয়নের মায়ের দূরসম্পর্কের চাচা।বুড়ো হেব্বি চালু।দুদিনের মধ্যেই নয়ন-কৌশিকের সম্পর্কের ব্যাপারটা আঁচ করে ফেললেন।একদিন বলেই বসলেন নয়নকে,'মাস্টার আসবে,পড়াবে চলে যাবে।তার সাথে অতো মাখামাখি করার কি আছে?'নয়নের বাবাও সেখানে ছিলেন।তিনি বললেন,'ছেলেটা সারাদিন একা-একা থাকে।তাই বোধয়.........।'
-'না বাপু।সেই মেলামেশার কথা বলছিনা।এ অন্য ব্যাপার।'

নয়ন কিছু না বলে সেখান থেকে উঠে চলে এল।মনটা কি একটা আসঙ্কায় ভরে উঠল ওর।কৌশিকের কোন ক্ষতি হবে নাতো।ওর বাবার টাকা আছে।নানা যদি তাকে উল্টো-পাল্টা কিছু বোঝান?
ওর আসঙ্কা সত্যি করে কৌশিকের এই বাড়িতে আসা বন্ধ হল।নয়নের জন্য অন্য একজন টিচার রাখা হল।একদিন সালমার মা এসে ওকে বলল,'ছোটভাইজান,কৌশিক ভাই আসছিল।দারোয়ান ওনাকে ঢুকতে দেয়নি।জোর করে ঢুকতে চাইছিল।দারোয়ান তারে অনেক মারছে।আমি তারে পিছন দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে আমার ঘরে এনে বসাইছি।'শুনেই নয়ন দৌড়ে গেল নিচতালায়,সালমার মায়ের রুমে।রক্তার্ত শরীর নিয়ে বসে আছে কৌশিক সেখানে।জড়িয়ে ধরল নয়ন ওকে।চুমুতে ভরিয়ে দিল সারা মুখ।কত কথা বলার আছে।কথা বলতে বলতে হাসছে,কথা বলতে বলতে কাঁদছে।কখন যে সময় কেটে গেল টেরও পেলনা দুজনের কেউ।হঠ্যাৎ দৌড়াতে দৌড়াতে ওখানে হাজির হল  সালেহা।'ছোটমামাজান,আপনার নানা আপনারে খুঁজতে খুঁজতে এইদিকেই আসতাছে।'চমকে উঠে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল কৌশিক।ওর গালে একটা চুমু দিয়ে বিদায় জানাল নয়ন।ফিরতে ফিরতে শুনল সালমার মা ওর নানাকে বলছে,'কি ব্যাপার!আপনি মহিলার ঘরে ঢুকবেন কেন?পরপুরুষ আমার ঘরে ঢুকতে পারবেনা।'অন্য দরজা দিয়ে নয়ন ওর রুমে ফিরল।

পরদিন কলেজের গেট থেকে বের হয়ে নয়ন দেখে কৌশিক দাঁড়িয়ে আছে। তারপর থেকে ওদের এভাবেই দেখা হতে লাগল।কিন্তু এবারও ওরা ধরা খেল ।শেষ পর্যন্ত বাসায় সিদ্ধান্ত হল নয়নকে বিদেশ পাঠিয়ে দেয়া হবে।সবার কথা শুনে নয়ন ঘরে ঢুকে দরজা দিল।ডজন খানেক ঘুমের ঔষুধ খেয়ে ফেলল একসময়।দরজা ভেঙ্গে নয়নের মরণাপন্ন শরীরটা উদ্ধার করা হল।দুইদিন যমে-মানুষে টানাটানি।তিনদিনের দিন চোখ মেলল নয়ন।হাসপাতালের বেডে ও।কেউ নেই আসে-পাসে।প্রথমে কিছুই মনে করতে পারলনা ও।আস্তে আস্তে সব মনে পড়ল ওর।কিন্তু সময়ের হিসাবটা মনে করতে পারছেইনা।অনেকক্ষণ একলা পড়ে থাকল ও।শরীরটা দূর্বল লাগছে খুব।একসময় একজন নার্স এল।ওকে সজাগ দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে।নয়ন খুব করে তাকে অনুরোধ করল যে তার বাড়ির কাওকে ডেকে নিয়ে আসে।বাইরে ছিল সালমার মা।সালমার মা ওকে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন।অনেক কষ্ট তাকে শান্ত করে নয়ন কৌশিকের কথা জানতে চাইল।কৌশিকের নামটা শুনেই মুখটা কেমন শুকিয়ে গেল সালমার মায়ের।
-'ছোটভাইজান,আপনার কাছে মিথ্যে কইবনা।যেদিন আপনি ঔষুধ খাইলেন সেদিন রাতেই কৌশিকভাই আসছিলেন বাসায়।পিছনের দরজা দিয়ে আমাকে ডাকল।আপনার এই অবস্থা শুনে কেমন জানি পাগল হয়ে গেল।পাগলের মত দৌড়াতে দৌড়াতে আপনার কাছে আসতে চাইল।বড় রাস্তায় উঠতেই একটা ট্রাক..................' সালমার মা আর কিছুই বলতে পারল না।কান্না আটকে গেছে তার গলায়।
-'কৌশিক!কৌশিক এখন কই?কৌষিক কেমন আছে?'কাঁপা-কাঁপা গলায় নয়নের মুখ থেকে যেন কথায় বের হচ্ছেনা।

সালমার মা কিছু বলতে পারছেনা।শুধু মাথাটা এদিক-ওদিক নাড়াল।ওতেই যা বোঝার বুঝে নিল নয়ন।এক লাফে বিছানা থেকে উঠে দাড়াল ও।কিন্তু ওর দূর্বল শরীরটা এই ধকল সামলাতে পারলনা।মাথা ঘুরে পড়ে গেল ও।হাসপাতেলের বেডে ঘাড়টা টুকে গেল।তারপর সব অন্ধকার।
আবার জ্ঞান ফিরলে দেখল ওর চারিদিকে লোকজনে গিজগিজ করছে।মাথাটা ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দেখল ও।উওঠে৪ বসতে চাইল।কিন্ত একি!ওর হাত-পা সাড়া দিচ্ছেনা কেন?
ডাক্তাররা অনেক পরীক্ষা করে রায় দিল ঘাড়ে আঘাত পেয়ে ওর brachial plexus lesion হয়েছে।তাই তার গলার নীচ থেকে সমস্ত শরীরটাই paralised.

তারপর থেকে আমাদের নয়ন বিছানায় থাকে।ওকে সুস্থ করার নানা রকম চেষ্টা চলছে।কিন্তু নয়নের কিছুই ভালো লাগেনা।কৌশিক ছাড়া সব কিছুই যেন কেমন লাগে।কারও সাথে কথাও বলেনা ও এখন।শুধু বৃষ্টি হলে বৃষ্টি দেখে ও।কৌশিকের সাথে কাটানো ওর বৃষ্টির দিনগুলো মনে পড়ে তখন।নিজেকে খুব বড় অপরাধী মনে হয় ওর।ওর জন্যই তো কৌশিককে মরতে হল।ওকে দেখার জন্য আসতে গিয়েই তো ও চলে গেল একেবারে।আবার মাঝে মাঝে কৌশিকের উপর খুব রাগও হয়।ওকে ফেলে স্বার্থপরের মত একা চলে গেল কেন ও?জীবনটা কেমন খাপছাড়া লাগে নয়নের।নিজেকে ওর বৃষ্টির ফোটার মত মনে হয়।চারপাশে বৃষ্টির ফোটার মর এতো মানুষ,কিন্তু তারপরেও একটা একটা বৃষ্টির ফোটার মত ও একাকী,নিঃসঙ্গ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?