দিগন্তে বসন্ত -ইরফান কাব্য

বসন্ত আসি আসি করেও এবার যেন একটু দেরিতেই এল।
সকাল থেকে ঝরঝরে মিষ্টি রোদ চেরি গাছের পরিষ্কার পাতাগুলোতে মিশে ঝিলিক দিচ্ছে।গুচ্ছ গুচ্ছ সবুজ চেরি। নাঃ সবুজ কোথায়? কবে কে যেন ছড়িয়ে দিয়ে গেছে গুড়ো গুড়ো খয়েরি রং।দিগন্ত খেয়াল করে রোমাঞ্চিত হল।ঘন বেগুনি হয়ে উঠেছে কোন কোন ফল।পাকতে শুরু করেছে চেরি। খবরটা আগে পেয়েছিল এখানকার নাম না জানা পাখিরা।সকাল বিকাল চক্কর দিচ্ছে। নামতে সাহস পাচ্ছেনা।....

পুরো শীতে অবহেলিত পেছনের গার্ডেন সাফ হচ্ছে।দুবেলা কাজ করছে টয় আর জার। হলদে,গোলাপি,নীল
চে পাখিরা নাসপাতির ডালে বসলে টয় রঙিন চোখ মেলে শিস বাজায়।জার অশ্লীল গালির সংগে ছুড়ে দেয় মুঠোভরতি পাথুরে মাটি। কিচেন সংলগ্ন ত্রিভুজ পাকা চত্বরের রেলিং-এ মাজেন্ডার পালিসের ব্রাশ চালাতে চালাতে দিগন্ত বলল,আহা নামতে দাও না উঠানে। স্বাদু ফল পাকছে।ওরা তো আসবেই।
-ছিঁড়ে ফেলে দাও তোমার দয়াবান মনকে।মানুষ ঘায়েল অর্ধাহারে আর ওরা এল তাতে ভাগ বসাতে।
-ইস নিরীহ প্রাণীগুলোকে এইভাবে বকছ?
-ওরা শোনে না বোঝে?তুমি শোন?
-শুনলে তোমার লাভ?
-বড্ড কঞ্জুস তুমি।ডলার নিয়ে কড়াকড়ি তোমার রোগে দাঁড়িয়েছে।
-না এলেই পার।
-পারিনা।নতুন কারো ডাকে সারা দিতে ইচ্ছে করেনা।
-করেনা কেন?
-ডাকটাই কি সব?তুমি কৃপণ অবিশ্যি। কিন্তু ফ্রেন্ডলি বিহেবিয়ার।
টয় আর জার ওদের দুজনের কাজ দুবেলা।মুখোমুখি দেখা হয় কম।হলে টয় প্রতিবাদ করে,
-জারের মাথায় পোকা।দিগন্ত কক্ষনো কিপ্টে নয়।বরং অন্যদের চেয়ে মজুরিতে ভাল।বিকেলের কফিটাও চলে।এই ঘোর কমার্শিয়াল যুগে সেটার দামও বড়ো কম নয়।
দুজনই ছাত্র।একজন রেগুলার।অন্যজন ইচ্ছেমত যায় আসে।টয় খানিকটা লাজুক।জার মুখপোড়া।গত বছর ওদের ডেকে এনেছিল আলাবি।বলেছিল,
-যেটার গায়ে প্রচুর এ্যাস তিল,সেটার সংগে সমঝে বুঝে কথা বল।মেলা বড়লোকের ছেলে।কিন্তু থাকে রাস্তায়।গরমে প্রচুর রোদ,ডিসেম্বরের প্রখর শীতের সংগে যুদ্ধ করে,তবু বাড়ি যায়না। অন্যটি যখন মরা ঘাসের চাবড়া ঝুড়িতে তুলতে ব্যস্ত দিগন্ত এক মগ কফি সামনে ধরে জিজ্ঞেস করেছিল,
-তোমার নামটি জানা হয়নি?
জবাবে লাল মুখ আরো লাল করে টয় বলেছিল,
-ঐ আর কি?
-মানে?
-ঐ যে অনেকের মুখের আদরের নাম জন টমি টয়।
-তো তোমার কোনটা?
-শেষেরটা।
-হ্যালো টয় আমি দিগন্ত।
- শুনেছিলাম পূবের মানুষেরা অন্য রকমের সৌন্দর্যের অধিকারী হয়। তোমাকে দেখে বুঝলাম কথাটা একদম সত্যি।
-এর আগে আর দেখোনি?
-দেখব না কেনো? অনেক দেখেছি। কিন্তু কারোর কাছাকাছি যাবার সৌভাগ্য হয়নি। টয় কথা বলছে,কাজ করছে আর ঢোকে ঢোকে কফি গিলছে।
দিগন্ত হেসে বলল, অন্তত পানের সময় হাত দুটোকে রেহাই দাও। কথা বলো চোখের দিকে তাকিয়ে। তাকালো টয়। ভাসা ভাসা দৃষ্টি-
- আজকাল সূর্য ডোবে দেরিতে। তোমার এখান থেকে ছুটি মানে রুমে ফেরা নয়। আছে এক ইহুদির কাঁটাবন। জঙ্গল সাফ করে তবে ঘর্। পরীক্ষার দেরি নেই। পড়ায় সিরিয়াস হওয়া। বোঝই তো। সো-- -সো?
-যন্ত্রের মতো যতো বেশি খাটতে পারব ততোই লাভ।
-ক্লান্তি নেই নাকি?
-কেনো থাকবেনা?অবশ্যই আছে।
-তোমার দ্বিতীয় বাড়ির লোকজন কেমন?
-দেখা হয়তো রোজ এক বদমেজাজী বুড়োর সঙ্গে। তবে সে আমার সাথে ভাল। ওর বৌটাও।ওদের ছেলেটি কোথায় যেন চাকরী করে। মেয়েটির বেশ বয়েস হয়েছে। বিয়ে সাদীর কোন নাম গন্ধ নেই। খালি বয়ফ্রেন্ড পাল্টায়। ছেলের ঘরে টিনএজ নাতনী আছে। নাইস গার্ল,আমার খুব ভালো লাগে।
-তারপর?
-তারপর আর কি?এটা তো রুপকথার মিথ নয়। রাজকন্যে থাকে তার পড়ার টেবিলে। ছুটির দিনে সেজেগুজে বের হয় সত্যিকারের রাজপুত্রের সঙ্গে। আর বাড়ির রাখাল সে দুবেলা নিয়ম মাফিক গরু চড়ায়। তোমার মত এই পরিবারটিও প্রতি বছর আমায় ডাকে। এই সূত্রে অনেককে জেনেছি। টয় দুহাতের ধুলোমাটি ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো-তোমার লিভিং রুমের টয়লেটটা খালি আছেতো?
-হুম তুমি যেতে পারো।
-তুমি কি আরো কিছুক্ষন কাজ করবে?
- নাহ খুব উতসাহ পাচ্ছিনা। এতক্ষন তোমার সঙ্গে গল্পে গল্পে বেশ ছিলাম।
-কিন্তু কিছুদিন থেকে মানে এবার এসে দেখছি তোমার কি যেন পরিবর্তন হয়েছে!আজ তো মনে হচ্ছে হাসি ভুলে গেছ।
টয়ের কথার জবাব সেও আশা করেনি আর দিগন্তও মুখ খোলেনি। চাতালের রেলিং লম্বা দুপায়ে পার হয়ে টয় চলে যেতে, দিগন্ত টের পেল আলাবি আসছে। পেছন থেকে আলগোছে দুহাতে জাপ্টে ধরে বলছে,এবার আমি কাজ করি তুমি বসে বসে দেখো।
-আমিতো কাজ দেখিনা। তোমায় দেখি। তো এলে এত পড়ন্ত বেলায়,সূর্য ঠিক আমাদের খাতিরে চলতি রথ থামিয়ে দেবে?
-কিচ্ছু দরকার নেই। আধারে আমরা নিজেদের আরো ভালো করে দেখতে পাই। পাই না? অভ্যাসমতো ঈষত ঘাড় কাত করেছিল দিগন্ত।
তখনি খেয়াল করল বাস্তব নয়,নিকট অতীতের স্মৃতি। ছবির মত সুন্দর এই বাড়ির দিকে দিকে কেবলি দীর্ঘশ্বাস। তবু বাগান পরিষ্কার হচ্ছে। চাতালের লোহার রেলিংয়ে রং পড়ছে। রঙ্গিন ছাউনির তলায় বারবি কিউ-এর আয়োজন। উজ্জ্বল আকাশ। মনোহর প্রকৃতি।
সর্বত্রই সেই সুখবর-বসন্ত আসছে।
গাছপালায় অন্ধকার জমাট বেঁধে পুরো বাড়ির সঙ্গে দিগন্তও কখন আধারের অংশ হয়ে গেছে। প্রতিবেশি পরিবার আজ সকালেই সমুদ্রের দিকে চলে গেছে কিছুদিনের আরামের ছুটি কাটাতে। ও বাড়িও আলোহীন।। ও বাড়ীর নেমপ্লেটে জ্বলজ্বল করে অক্ষরের বদলে একঝাক নীড়মুখী পাখি। এ বাড়ীর টেপোজ বরণ ফলকে চমকায় দুটি শব্দ 'হারস স্মাইল'। এখানে আসার পর রায়হান চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করেছিল- আপনার বউ এর হাসি কি খুব মিষ্টি ছিল?
জবাবে দুভুরুর মাঝে বেশ কয়েকটা টান ফেলে বিরক্তি প্রেকাশ করেছিল রায়হান
-নাহ তোমাকে আর আপ টু ডেট করা যাচ্ছেনা। কবে যাবে তোমার থেকে বাংলাদেশের গন্ধ? বুকে চাকু খাবার বেদনা কেমন কে জানে! দিগন্ত শুরুতে খুবই আহত।
পরে দুর্বল গলায় বলত-জেনে শুনে এনে এখন নাকাল করা কেনো? এদেশেই তো আপ টু ডেট জন জেমস কতো ছিল, নিয়ে এলেই হত একজনকে।
-আমার সোসাইটি রয়েছেনা?
দিগন্তের মনে হয়েছে আসলেও তাই। পরক্ষণে নিজেকেই প্রশ্ন করে, আসলেই কি তাই? দেশে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র উপার্জন করুয়া বাবা যখন পাঁচ মেয়ে আর তিন ছেলের ভরন পোষনের দায়ে ক্লান্ত তখনই দিগন্ত সন্ধান পেয়েছিল তার থেকে প্রায় ছাব্বিশ বছরের বড় ও দুই ছেলের বাবা রায়হান চৌধুরীর্। দিগন্ত মন থেকে একজন পুরুষকেই তার জীবন সঙ্গী হিসেবে চেয়েছিল। তাই বলে তার থেকে ছাব্বিশ বছরের বড় বিবাহিত দুই ছেলের বাবাকে! তবুও পরিস্থিতির কথা ভেবে চিন্তা করেছিল মানিয়ে নেবে। অহংকারী বউ এর সাথে বনাবনি হয়নি রায়হানের। ফলাফল ডিভোর্স। রায়হানের সাথে দেশ ছাড়ে দিগন্ত। প্রতিশ্রুতি ছিল রায়হান তাকে অর্থ উপার্জনের সুযোগ করে দিবে। পরিবার কেও সেই কথাই দিগন্ত জানিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী ঘটনা ছিল উল্টো। দিগন্ত যেন শুধুই রায়হানের গৃহরক্ষী। কাজ আর করতে দেয়নি। প্রতি মাসে অবশ্য দেশে দিগন্তের পরিবার টাকা ঠিকই পেয়ে যেত। ভাবত ছেলের উপার্জন। কিন্তু দিগন্ত তো অন্যকিছুই চেয়েছিল। রায়হানের বাড়িতে যে সোনার জামাই তার 'হারস স্মাইলে' প্রথম প্রবেশটা কেমন ছিল? দোতালার সিঁড়ির নিচে কাঁদ কাঁদ মুখে দাঁড়িয়েছিল বিশ বাইশের এক তরুন। খাঁটি রুপার চাবির গোছা হাতে তুলে বলেছিল, ঘর বাড়ি বুঝে নিন। আমি আজ রাতের প্লেনেই ভিয়েনা চলে যাচ্ছি। দিগন্ত বুঝেও চুপসে রইলো। রায়হান চৌধুরী মাসের মধ্যে পনের দিন থাকে বাইরে। আলাবি শুরু থেকেই বাঁকা। একরত্তি সহযোগীতায় হাত বাড়াতনা। হরদম ওর চোখে মুখে এমন ভাব লেগে থাকত যেনো দিগন্ত কোন খুনী আসামী। যদিও ঐ আলাবির কাছ থেকেই কোন এক অসতর্ক কিংবা ইচ্ছাকৃত আক্রমনে সে জেনেছিল, স্ত্রীর সঙ্গে মোটেও ডিভোর্স হয়নি রায়হান চৌধুরীর্। মফস্বল শহরে আরো একটি সন্তান নিয়ে বহাল তবিয়তে আছে সে। বাবা মা দুজনকেই সমান ঘৃনা করে আলাবি। ঢোক গিলে দিগন্ত যেন জুয়াখেলার মত একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিল- আমাকেও?
-ঠিক জানিনা। হয়ত তোমাকেও।
আলাবি ফিরে না তাকিয়ে ওপরে নিজের ঘরে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। এমনিতেই একা একা লাগে। ক্যাসেলের মত বাড়িটা আগ দুপুরে যেন হা করে গিলতে আসত। এই বাড়ির অর্ধেক মালিকানা দিগন্তের্। হয়ত ভাল মানুষী অথবা দিগন্তের ভবিষ্যত থাকার কারন হিসেবে আস্বস্ত করতেই রায়হান চৌধুরী স্বইচ্ছায় ব্যাপারটা ঘটিয়েছে। সাধারন বাঙ্গালির চৈতন্যের কুন্ঠা নিয়ে আলাবিকে সে জিজ্ঞেস করেছিল, -তুমি না জানি আমার সম্পর্কে কি ভাবছ!
চড়া হাসিতে লিভিংরুমের প্রশস্ত স্পেস ভরিয়ে দিয়ে প্রতি পক্ষ জবাব দিয়েছিল,
-হা ভারি একটা বাড়ি। বাবা তো দুরে থাক আমার যা ব্যাংক ব্যালান্স আছে, কালই ইচ্ছে করলে অমন এক হালি হয়ে যায়।
রান্না বলতে একবেলা। তাও সব দিন নয়। রাস্তার ধারে বাড়ি। এইসব বড়লোকের পাড়ায় মাঝে মধ্যে প্রাইভেট গাড়ি আসে যায়। পথচারী বলতে হাতে গোনা। শব্দ যা কিছু কুকুরদের চিতকার্। নিজের সাথে দিগন্ত কথা বলে, পুরো পাড়ায় ওদের সঙ্গে কেবল আমি। নাহ,সঙ্গী আরো আছে। বসার ঘরে টেলিভিশন,নানা মিউজিক সিস্টেম। ফোন কডলেস মোবাইল। ওদের সঙ্গে সময় কখনো সচল হয়। একসময় খালি ঘরে কথা বলে, যন্ত্র কি পারে মানুষকে সত্যিকারের সুখী করতে! রায়হানকে খুলে বলতে আর সাহস পায়না। একলা বাড়িতে লিভিং রুমে রায়হানের ছবির তলায় দাঁড়িয়ে তলত, তোমার অফিসে কতো কর্মচারী। আমায় একটা কাজ দাও। মাইনে চাইনা,শুধু কাজ। উইকেন্ডগুলো মাঝে মধ্যে প্রানবন্ত হয়। কিংবা পরিচিত দেশি বিদেশি ঘরোয়া ফাংশন। চমতকার পার্টি। তারপর আবার সেই যেই। বন্ধু বয়েসী মি: তরুন পরামর্শ দিল
বন্ধু বয়েসী মি: তরুন পরামর্শ দিলেন- বেবি এডপ্ট করো। দিন কেমন করে চলে যাবে টের ও পাবেনা। পরামর্শ পছন্দ হল। এলো অর্ন। তবে অর্নকেও দুবছরের বেশি আকড়ে থাকা গেলনা। স্কুলেই কাটে সকাল বিকাল। মাঝে মাঝে যেন ঠাট্টার মতো খাবার টেবিল থেকে ভেসে আসে আলাবির কন্ঠস্বর-কি কেমন আছো?
-তুমি তো ভাল করেই জানো,জিজ্ঞেস করো কেন?
-বারে আমার কি কিছু দায়িত্ব নেই?
-বাপ বেটা দুজনে দায়িত্ব পালন করে তো আমায় ভাসিয়ে দিচ্ছ।
-আজকাল দেখছি বেশ কটাস কটাস কথা বল।
-বলিনা। তোমরা বলাও। দিগন্ত ফ্রিজ থেকে ভাজা মুগের ডালের বাটি বের করে আলাবির দিকে ঠেলে দিয়ে বলে, মাইক্রোওভেনে দাও।
-শুধু ডাল? আর কিছু গরম করতে হবেনা?
-না।
-শুধু……
-উম ডাল দিয়ে ভাত খেতে হবে।
-এই খাবার জন্য দুপুরে বাড়ি ফিরলাম?
-কে বলে ফিরতে? বাইরে কত খাবার্।
-এদ্দিনে তো আমার উইক পয়েন্টটি ভালই টের পেয়েছ। তারপরও এই ব্যবহার্। যাও খাবই না আজ। ভাতের প্লেট এমন করে ঠেলে দিল,দুটুকরো হল মেঝেতে পড়ে। সোজা হাঁটা দিল মেইন গেইটের দিকে। দিগন্ত জানত ওকে ফিরে আসতে হবে। শহরের বাইরে মিঠা পানির ঝিলে মাছ ধরতে যাবে। যাবতীয় সরঞ্জাম দোতালায়। তাছাড়া সত্যি কি শুধু বাসি মুগডাল? নিজেরই প্রয়োজনে সে হাজির হয় এখন সেই সব বাজারে যেখানে বাংলাদেশের কচুঘেচু থেকে পাবদা পুঁটিও হাজির হয়। এই একটি ক্ষেত্রে আলাবির সঙ্গে খুব মেলে। বিশেষ করে ভাত নিরামিষ,মাছের ঝোল,চড়চড়ি। রায়হান খুব সকালের ফ্লাইটেই আফ্রিকা গেছে। দিগন্ত আর বিছানায় ফিরে যায়নি। শনিবারের সকাল। গাড়িটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। রাজ্যের সওদা নিয়ে রান্না করেছিল গোলসা মাছের আলু ডাটার লাল ঝোল,নারকেল দুধের কচুর লতি,পাঁচ মিশেলী শাকের ডিমের ঘাটা। সবই ঢেকে রেখেছিল চুলার ধারে। ওভেনের কাছে গেলেই চোখে পড়ত আলাবির্। ঠিক সে খুশি হত। অথচ কি ঘটতে কি ঘটল?
গতরাতে স্যাটারডে নাইট করে আলাবি কখন বাড়ি ফিরেছিল জানেনা দিগন্ত।দোতলায় আলিশান তিনটি বেডরুম থাকলেও আলাবি থাকে তেতলার একমাত্র ঘরটিতে। বন্ধুদের সাথে আডডা দেয়,হৈ হুল্লোড় করে। মেইন গেটের চাবি থাকে প্রত্যেকের কাছে।ব্রেক ফাস্টে ডাকতে গিয়েছিল দিগন্ত। দুহাত দুদিকে দিয়ে নিবিড় ঘুমে তলিয়ে আছে আলাবি। দুহাত দুরে বসে তাকিয়ে ছিল দিগন্ত-
দীঘল দেহ,অবাধ্য চুল,চেহারায় এখনো লেগে আছে দুরন্ত কৈশোরের লাবন্যপ্রভা।একটু তেজি,অসহিষ্ণু,মাঝে মাঝে কিছুটা ভাবুক লাগা যুবককে মনে হচ্ছিল একদম নিষ্পাপ একটি শিশু।ঘুমের ভেতর সে যেন কথায় হারিয়ে গেছে।। দিগন্তর ইচ্ছে করছিল স্পর্শ করতে। খাবারের টেবিলকে কেন্দ্র করে এই কবছরে যে সখ্যতা গড়ে উঠেছে তাতে ছোঁয়াছুঁয়ি বলতে দুচারবার হাত ধরা। এখন ওর চুলে,সুঠাম বুকে আদর করতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু নিজেকে সংযত করতে,বলতে গেলে ছুটে পালিয়ে এসেছিল দিগন্ত। 
 
দুপুরের দিকে আলাবি গোসল সেরে ভেজা চুলে হাতের থাবড় দিতে দিতে কিচেনের কাছে এসে বলেছিল
-খুব খিদে লেগেছে,খেতে দাও শিগগির্।
হাই টুলে বসে দিগন্ত বলেছিল-ছুটির দিন আজ। কি খেতে দিব বলো তো?
তারপর আবারো সেই আগের ব্যাপার্। দিগন্ত ছুটে গিয়েও ওকে ধরতে পারল না।নিজেকে মারতে ইচ্ছে করছিল দিগন্তর্।
বলেছিল- এত বদরাগি হলে কি বাস করা যায় তার সঙ্গে?আমি তো কেবল ঘর পাহারা দেবার যক্ষ। আমার খেয়াল খুশি বলতে কিছু থাকবে কেন?আমি হচ্ছি হাট বাজারে পড়ে থাকা পুতুল। তোমাদের বাধ্য বিশ্বাসের কেনা কৃতদাস। আমায় কি অশ্রু ছাড়া আর কিছু মানায়?কিন্তু তুমি তো সৌভাগ্যের রাজপুত্র, তুমি কেনো দু:খকষ্ট করবে?জানি আজ তোমার খাওয়া হবেনা। কে জানে কিভাবে কাটবে সারাদিন? অর্ণ স্কুল থেকে চলে গেছে এক বন্ধুর বাড়ি। মিসেস ডেনের ছেলেটির জন্মদিনের পার্টি রয়েছে। ক্লোজ বন্ধুরা থাকবে দুদিন। সোমবার বিকেলে তিনিই নামিয়ে দিয়ে যাবেন বাসায়। কাছের মানুষেরা ধাঁধাঁর মতো। নিজের জীবনটা বোঝার মতো দিগন্তর্। যা বা যতটুকু খুশির আদানপ্রদান পুরোটাই আলাবির সঙ্গে।অজান্তে ওকে বন্ধুও ভাবে। বৈদেশে একমাত্র বান্ধব। দিগন্ত সারাদিনে কিছুই খেলনা। বড় লোকের পাড়া উইকেন্ডেতে আরো জনশূণ্য হয়ে যায়।গাড়ি চলাচল কমে যায়। তবু চাকার শব্দ পেলেই ছুটে যায় জানালার ধারে। শেষবেলায় একটা জিপ এসে দাঁড়াল বাড়ির সামনে। আলাবি নামছে ইয়া বড় একটি মাছ হাতে করে। ছুরিতে চমতকার স্লাইজ করে আলাবি। দিগন্ত চুলায় দেয় প্যান। গরম গরম মাছ ভাজা বড় পছন্দ ওর। যেমন পছন্দ মাছ ধরা। আজ সাজ সরঞ্জাম সঙ্গে যায়নি কিন্তু শিকার হয়েছে ঠিক।
দিগন্ত যখন কিচেনে এল,বেসিনে পাকা পোস্তায় ছুরিতে মাছের আঁশ পরিষ্কার করে চাক চাক টুকরো করছে আলাবি। একটু বেকায়দায় রয়েছে। আকারে বেশ বড় মাছ। দিগন্ত মাছের লেজের দিকে ধরে বলল-আজকের শিকারটা বেশ ভাল হয়েছে। নাহ!অপরপক্ষের কোনো জবাব নেই। ঝুঁকে ছিল। সামনের লম্বা চুলের খানিকটা ঝাকানি খেল শুধু।
দিগন্ত বলল-জানি রাগ হয়েছে খুব। কিন্তু এতটুকু সবুর কি করতে নেই?
তবুও নীরব অপর পক্ষ। দিগন্ত জুত মতো দুহাতে মাছ শক্ত করে ধরতে আলাবি বলল-হাত সরাও।
-না সরাবো না।
-আমায় কাজ করতে দাও।
-না।
-আমি থামতে জানিনা।
-থামতে কে বলেছে? কথাটা শেষ করেই দিগন্ত প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, উহ: ।
সোজা হয়ে দাঁড়াল আলাবি। করেছে কি?মাছের বদলে ছুরি বসিয়েছে দিগন্তর কব্জিতে। রক্ত ছুটছে ফিনকি দিয়ে। আলাবি ছুরি ফেলে দিগন্তের ক্ষত মুখে চেপে ধরল। যতোক্ষন বন্ধ না হলো চুষেই চলল।আঘাত কত গুরুতর বোঝার শক্তি ছিলনা দিগন্তর্। সে নিস্তেজ হয়ে পড়ছিল। ঝুকে যাচ্ছিল। তার মাঝে বুঝতে পারছিল আলাবি তাকে বুকে চেপে ধরেছে। একটা একটা করে সিঁড়ি ভেঙ্গে তুলে নিয়ে এসেছে নিজের ঘরে। ওষুধ লাগিয়ে আনাড়ি হাতের ব্যান্ডেজ দিয়ে হাঁটু ভাজ করে বসেছে দিগন্তের কোলের কাছে। পুরো মুখ বুকের ভেতর গুজে দিয়ে অস্ফুটে বলল-কি করলাম!! একটি হাত অবশ। বাকি হাতে আলাবির মাথা চেপে ধরে দিগন্ত বলল-ভালোই করেছ।
-তোমার রক্তের স্বাদ এত মিষ্টি!
-আবার পান করো।
-বারবার পান করব যদি তুমি কষ্ট না পাও।
-পৃথিবীতে কষ্ট বলে কিছু আছে এখন আমার আর মনে হচ্ছেনা।
-জানো,আজ সারাদিন আমি কিছু খাইনি।
-আমিও না।
-আমাদের খাওয়া দরকার্।
আলাবি মুখে যা বলছিল চোখের দৃষ্টির সঙ্গে মিল ছিলনা। ওর চাউনি ভরে এত মমতা আগে কখনো দেখেনি। সেটা ক্রমশ দেহে মনে ভর করছে তাও বুঝতে পারেনি। শুধু শুনেছিল আলাবির কাঁপা আঁঠাল স্বর-তুমি কখনো আমায় ক্ষমা করোনা।
জবাবে দিগন্ত আলাবির মুখে মাথায় একটি হাতে আদর করেছে-খাবে না?
-না: আর আমার কোনো জাগতিক খিদে নেই।তোমার আছে?
-আমারো নেই।
আলাবি ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে ফুলদানি থেকে একটি ঘন লাল পপি তুলে নিয়ে দিগন্তের হাতে দিয়ে বলল-আমার প্রথম প্রেমের উপহার্।
দিগন্ত বলল-ঠাট্টা করছ?
আলাবি ঘাড় বাঁকাল-নাহ একদমই না।
এদেশে শরীর নিয়ে খেলা নতুন কিছু নয়। নতুন মন দেওয়া ও সপে দিতে পারা। পাঁচ বছর তুমি এখানে এসেছ। পাকে চক্রে বহুবার আমাদের ভালোবাসা বিনিময় হয়েছে,আজ সেই নদীর সাগর সঙ্গম ঘটে পরম পরিতৃপ্তি লাভ।
-ব্যাপারটা গোপন থাকবেনা।
-গোপন থাকুক সেটা আমিও চাইনা। ওই লোকটা যিনি আমার জন্মদাতা তাকে কোনদিন আমি পছন্দ করতাম না। মাকেও না। রায়হান চৌধুরীর কি খেলার ডলের কমতি আছে?যে দেশে বাণিজ্য করতে যায় সঙ্গীরও অভাব থাকেনা। তুমি মনে করোনা তোমার কোনো ব্যাপারে তার যাবে আসবে।
না আলাবির মতের সাথে মত মেলাতে পারেনি দিগন্ত। একটা সময় বুঝেছিল বাপ ছেলের পারস্পরিক চেনাটা খুবই গভীর্। এক ছাদের তলায় বসবাস। কথাবার্তা বলতে ব্যাবসায়িক। গত দুবছর রায়হান চৌধুরী ভিন্ন ঘরে রাত্রিবাস করছে। দিগন্ত কৃতজ্ঞ এই বিষয়ে।
ত্রিশ বছরের জীবনে দিগন্তের জীবন সম্পর্কিত ভাবনার রুপটা ছিল-মানুষ এই দুনিয়ায় আসে হাজতি আসামির মতো।বাকি সময়টা কেবলি কারাগার বাসের গ্লানি।এই মলিনতা নিয়েই সে একদিন চলে যায় যেখান থেকে এসেছিল সেখানে। আলাবির সঙ্গে আত্মিক দৈহিক সম্পর্কের পর তার চিন্তা মোড় নিয়েছে।ঘোর কিংবা সত্য প্রাপ্তির ভেতর থেকে সে উচ্চারন করেছে, বিধাতা মানুষকে একটা কাংখিত পৃথিবীও দিয়ে পাঠায়।সেটা আবিষ্কৃত হয় দেহের সঙ্গে দেহ, আত্মার সঙ্গে আত্মার মহামিলনে। 'হারস স্মাইল'-এ চলে পার্টি।রায়হান চৌধুরীর বন্ধুদের নিয়ে জমে উঠে এইসব দুপুর কিংবা সন্ধা।বাইরে তো প্রশ্নই আসেনা,ঘরের গেদারিং-এও আলাবি থাকেনা।তবে ইদানিং ঘরোয়া গেদারিং এ কিচেনের ব্যাপারে সহযোগিতা দেয় দিগন্তকে। শুরুর দিকে কারোর গ্রাহ্যের মধ্যে আসেনি। পর পরে অনেকের বিশেষ দৃষ্টির আদান প্রদান ঘটেছে। প্রতিবাদে আলাবি যেন আরো হিংস্র অথবা প্রকাশিত হতে বেশি পছন্দ করেছে।মাঝ রাতের ভাঙ্গা আসরে দিগন্তকে ডেকে বলেছে,আমার কফিটা ঘরে পৌঁছে দিও। কফি দিতে গিয়ে দিগন্তর আর ফেরা হয়নি।ফিরতে দেয়নি আলাবি। ফিরতে চায়নি দিগন্ত নিজেও। হয়ত গোটা যামিনী পার হয়েছে মুভি দেখে,গান শুনে,রোমান্টিক সাহিত্য পাঠে একান্ত দুই বন্ধুর মতো।জেগেছে দুরন্ত যৌবনের দুটি মানুষ। দেখেছে নীরব নিকষ অন্ধকার রাত্রি আর শিশু সূর্য ওঠার অমল প্রভাতকে। জীবন যাপনে এত সাপোর্ট কেউ কখনো তাকে দেয়নি। তবু কখনো একাকী সময়ে তুফান উঠেছে। মনে হয়েছে পৃথিবীর সব মানুষের বুকে একটা আদিম জঙ্গল রয়েছে।সেখানে বসবাস প্রতিহিংসাপরায়
ণ একটি মনের্।
গত বছর কাজ করতে এসে এক বিকেলে জার না জানি কতদিনের ব্রাস করা দেঁতো হাসি দিয়ে বলেছিল-আজ যে তুমি বড্ড চূপচাপ। শরীর ভাল তো?
উল্টো প্রশ্ন রেখেছিল দিগন্ত- তোমার কি মনে হয়?
-শারীরিক ভালো। মানসিক একদম নয়।
-ঠিকই ধরেছ।
-দেখো আমি মাত্র তেইশ পেরুচ্ছি। কিন্তু মানব জীবনের একটি সার কথা আবিষ্কার করে ফেলেছি। দুটি মানুষের দৈহিক মিলমিশের ব্যাপারটা বড্ড জটিল,গোলমেলে।
-কেমন করে বুঝলে? কটা মেয়েকে দেখেছ?
-সত্যি বলতে একটিও না। আমার সম্পর্ক রবার্টের সঙ্গে। ওর বয়শ একুশ।
-সেও তোমার মতো বড়লোকের ছেলে?
-শুধু বড়লোক নয়,ওর বাপ আমার বাপকে কয়েকবার কিনতে পারবে। আর আমার আরো দুটি ভাই আছে। ও এক বাপের এক ছেলে।আমরা একসাথে আছি পাঁচ বছর্। আমাদের কোন সমস্যা নেই। বাড়তি আকাংখা নেই।দুজন বেশ ভালই আছি। তাই হয়ত দুজনের কারোরই মনে পড়েনা নারীর কথা।
-বয়সটা আরো পাঁচ বছর বাড়লে এ কথা তুমি বলবেনা।
-জানিনা। এক একটা মানুষ নিজের কাছেও রহস্য। আগেই বলেছি আমাদের বাড়তি চাওয়া নেই। তবু যদি কখনো বিয়ের প্রয়োজন বোধ করি রবার্টের সঙ্গে রিং বদল করব।
-এমনি এমনি পৃথিবী থেকে চলে যাবে?
-কি আশ্চর্য!আমরা তো এসেছিই চলে যাবার জন্য। যতক্ষন আছি ততক্ষন আছি। যখন থাকব না একদম সাফ হয়ে যাব। মাঝের কিছুদিনের জন্য কিই বা প্রয়োজন! বেশ তো আছি আমরা।
-কেমন আছি আমরা?
-যেমন থাকার কথা,দুটি লিঙ্গ মিলনের মধ্যে নানা সংঘর্ষ অপরিহার্য।
-এই হিসেব থেকে কি আমরা নিজেদের ফাঁকিবাজ বলতে পারিনা?
-অবশ্যই পারো। একটা জীবনেরই তো ব্যপার্। যে যেমনভাবে পারে হেসে খেলে দিন কাটাক। আনন্দই এই জীবনের আসল খবর্। প্রেমময় ভুবন।
জার হাত ঝেড়ে বলল-ওসব এখন বাদ দাও। তার চেয়ে এক মগ কফি দাও,জুত করে খেয়ে চলে যাই। জারের সঙ্গে কফি পান করতে গিয়ে বারেবারে আনমনা হয়ে যেত দিগন্ত। জারের মত খোলা মনের,পরিচ্ছন্ন ভাবনার অধিকারী হলে অনেক জটিলতা জয় করতে পারত সহজে। অর্ণ এখন থাকে বোর্ডিং স্কুলে। উইকেন্ডে বাড়ি ফেরে। নতুন বাড়ি দেখছে আলাবি।
বলছে, ঐ লোকটার দান করা প্রাসাদে আর থাকব না। তুমিও না আমিও না। কয়েকটা বাড়ি দেখেছি। যেটা তোমার পছন্দ হবে সেটাই নেব। তোমার আর আমার নামের মিল রেখে স্বর্গ বাড়িটার নাম হবে 'আদিবাস'। শুনতে শুনতে কোথায় হারিয়ে যায় কিংবা কিছুই শুনতে পায়না এতটা আনমনা দিগন্ত। আলাবি দুকাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দেয়- কি কোথায় রয়েছ?
-জানিনা।
-আজকাল তুমি যেন কি ভাবো! কী হয়েছে তোমার? কী প্রবলেম?
-স্পষ্ট বুঝিনা।
-বোঝ বোঝ খুব বোঝ। যে আলাবি রাগী সে কোন লুখোছাপা জানেনা।
বলল-তোমায় পেয়েছে মেয়েলি আর বাঙ্গালি সেন্টিমেন্টে।
মানতে পারেনা আবার প্রতিবাদও করতে পারেনা দিগন্ত।
নিরালায় অর্ণকে জড়িয়ে প্রশ্ন করে-আমরা যদি আর এখানে না থাকি?
-অসুবিধাটা কি? থাকব না।
-শুধু আমরা তিনজন।
-উম আমরা তিনজনই তো। অর্ণ বসার ঘরের দিকে তাকাল। আলাবি কখন ফিরেছে টের পায়নি দিগন্ত।
অর্ণ আলাবির সঙ্গে হাসি দিয়ে বলল-আমি উইকেন্ডে তোমাদের কাছে আসব। যেমন যায় আমাদের ক্লাসের টনি আর জন। ওদের দুজনেরই স্টেপ ফাদার্।
অর্ণ ফিরে গেলে কখনো মন খারাপ হলে আলাবি দিগন্তকে নিয়ে লং ড্রাইভে বের হয়। নয়তো যায় বন্ধু বান্ধবের কাছে। ফেরে হাস্যজ্জল দিগন্তকে নিয়ে। সেদিন আলাবি একদম কাছে এলনা। অথচ দিগন্তর খুব প্রয়োজন ছিল ওকে। বালক অর্ণ হাসি মুখে যে সিদ্ধান্ত জানিয়ে গেছে,বুকের ভেতর উঠেছে অচেনা এক তুফান। যা সামাল দেবার জন্য প্রয়োজন এক শক্ত আর প্রেমময় বুকের্। দিগন্ত তেতালার ঘরে এল। টিভির চ্যানেলে কি যেন চলছে। আলাবির মুখ যদিও সেদিকে ফেরান কিন্তু চোখের উপর একটি হাত। দিগন্তের নি:শব্দ প্রবেশ ঘটতেই সে প্রশ্ন করল- আমার পপিটা তোমার ঘরে শুকিয়ে আছে দেখলাম। দিগন্ত জবাব দিলনা। গত দুবছরে রোজ একটি ফুল তার প্রাপ্য ছিল। সেই রাত্রি থেকে। পপি সারাবছর পাওয়া যায়না। শীতে অজস্র ফোটে। মাঠকে মাঠ আলো করে দেয় লাল হলদে রং- এ। সামার আসলেই সব অদৃশ্য হয়ে যায়। আবার ঠিক ঋতুতে নিজ থেকেই গজায়। সেই সময়েও আলাবি নিয়মিত থাকত কাংখিত পপি হাতে। দিগন্ত যত্ন করে ফুলদানিতে রেখেছে। কিন্তু গত কিছুদিন প্রায়ই ফুল শুকিয়ে যায়। যথাস্থানে রাখা হয়না। আলাবির নজরে এসেছে আজ। সেটা সে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে নিজের ঘরে। প্রশ্নটা আরো একবার করে জবাব না পেয়ে উঠে দাঁড়াল আলাবি।
দিগন্তের দুকাঁধে থাবা বসিয়ে বলল- আমার দিকে থাকাও। স্পষ্ট করে শোনো কয়েকটা কথা।
ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠে ঢোক গিলে দিগন্ত বলল- বলো!
আলাবি চোখ থেকে চোখ সরাল না। বলল - আমাদের চিন্তা ভাবনা আজকাল দুমুখী তা আমি বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু তোমাকে একটা কথা বুঝতে হবে, দুবছর আগে আমাদের সম্পর্ক যখন শুরু হয়েছিল তখন আমি ছিলাম পঁচিশের পরিপূর্ণ যুবক। এখন সাতাশের পরিপূর্ণ পুরুষ। আমার এখন একটা নিজের মানুষ চাই। একান্তই আমার নিজের্। একটা সুখের জীবন চাই শুধু তাকে নিয়ে। আজ রাতে আমি বাড়ি ফিরবনা। কাল ফিরব আর একটি তাজা পপি নিয়ে। তোমার স্বাধীনতা রইল, ইচ্ছে করলে দুয়ার খুলো। ইচ্ছে হলে খুলো না … …………… শুনছো?
দিগন্ত চমকে উঠল।
টয় ওয়াসরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে হেঁটে যেতে যেতে বলল- আমি যাচ্ছি। দরজা বন্ধ করো।
-তুমি বাইরে থেকে লক করে দিয়ে যাও।
কখন চলে গেছে টয়। সেই থেকে লিভিং রুমের কোণের জানালায় দাঁড়িয়ে দিগন্ত। বেলা যে চলে যায়। আলাবি কোথায়?
সন্ধ্যার দিকে গেটে গাড়ি পার্কিং এর আওয়াজ। বুকের ভেতর প্রচুর শব্দ নিয়ে দিগন্ত উঠে দাঁড়াল। শ্বেত পাথরের সিঁড়ির দিকে দাঁড়িয়ে আছে যে যুবকটি, তার মুখ ম্লান আর গম্ভীর্। চেঞ্জ করা হয়নি গত রাতের পোশাক। শুধু প্যান্টের পকেটে রাখা তাজা একটি পপি।
দিগন্ত এসে আলাবির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গভীর মমতায় প্রশ্ন করল- সারারাত ঘুমাওনি?
আলাবি ফ্যাকাসে হাসল-পারলাম কই?
যেন প্রচুর নিশ্বাসের ঘাটতি ছিল, এমনি স্বরে দিগন্ত বলল-আমিও পারিনি।
-তাহলে এস। আমি গাড়িতে স্টার্ট নিচ্ছি।
আলাবি ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে বাঁধা পেল।
দিগন্ত ওর ডানায় হাত রেখে বলল
-এখান থেকে কিছুই আমার নেবার নেই। তোমার সঙ্গেই বেরুবো।
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?